আরবি মাস শাবানের পর আসে রমজান। এই মাসেই মুসলিমরা রোজা রাখেন। আরবি মাস চন্দ্র ক্যালেন্ডার মেনে চলে। ইংরেজি মাস ও বাংলা মাস চলে সৌর ক্যালেন্ডারে। তাই রমজানকে আমরা পৃথক ইংরেজি ও বাংলা মাসে দেখে থাকি। ইসলামের আবশ্যিক পালনীয় কর্তব্যের মধ্যে সিয়াম বা রোজা অন্যতম। রোজা (Roza) ফারসি শব্দ। সিয়াম আরবি। যেমন নামাজ ফারসি শব্দ, সালাত আরবি। সাধারণ মুসলিমরাও অনেকেই এই আরবি ও ফারসির ফারাক বোঝেন না। অবশ্য সাধারণের জন্য সেটা যে সর্বদা খুব জরুরি তা-ও নয়। কিন্তু রোজা আসলে ঠিক কী তা বোঝা খুব জরুরি। রোজা কাকে বলে, এ-কথা জিজ্ঞাসা করলে প্রতিটি মুসলিমই এর সঠিক জবাব দেবেন। কিন্তু তার পরও কথিত রোজা এবং প্রকৃত রোজার মধ্যে থেকে যায় দুস্তর ব্যবধান। সেই কোন কাল থেকে সেই ব্যবধান যেন ঘুচছেই না।
ধর্ম অন্তরের জিনিস, উৎসব ও উদযাপন বাইরের। ধর্মকে যখন আমরা প্রবলভাবে বাইরের জিনিস করে ফেলি, গোল বাধে তখনই। রোজা অন্তরের জিনিস। তা আলাদা করে প্রদর্শনের বিষয় নয়। যদিও রোজাকে আজকাল অনেকে উদযাপনের বিষয়ই বানিয়ে ফেলেছেন। আসলে পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয়। এই দেশে তথা এই বিশ্বে বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা অভুক্ত থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু তা বলে তাঁরা রোজা রাখেন এ-কথা বলা যাবে না। কারণ রোজার ব্যাপ্তি অনেকটা জুড়ে।
রোজা (Roza) হল পরিপূর্ণ সংযমের কঠিন অনুশীলন। সেই সংযম যেমন দেহের, একইভাবে সে-সংযম মনেরও। কেবল মনের সংযম যেমন রোজা নয়, তেমনই কেবল দেহের সংযমকেও রোজা বলা যাবে না। দেহ ও মনের সম্মিলিত সংযমের নাম রোজা। সে-রোজার উদ্দেশ্য পরম করুণাময় স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ। আনন্দের সঙ্গে সংযমের সম্পর্ক। অসংযমী মানুষ মোহগ্রস্ত। সে মাতাল হয়ে আনন্দ পেতে চায়। সে উচ্ছৃঙ্খলা ও আনন্দের ফারাক ধরতে পারে না। রোজা যেহেতু দেহ ও মনে সংযম তাই দেহে ও মনে আনন্দ অনুভব করতে হলে একজন মুসলিমকে পথ হাঁটতে হবে পরিপূর্ণ রোজার মধ্য দিয়ে।
এই মাসের কঠিন অনুশীলনে বাকি ১১ মাসের দায়-মুক্ত হওয়া যায় না। এই একটি মাস বাকি ১১ মাসের চালিকাশক্তির মাস। রোজার একমাস মুসলিমদের কাছে কৃতকর্ম ও অনুশোচনার মাস। স্রষ্টার কৃপা লাভের মাস। দীন-দরিদ্রকে দান করে স্রষ্টার অধিক সন্তুষ্টি অর্জনের মাস। রাতের অন্ধকারে কিংবা দিনের আলোয় যে-পাপ হয়েছে তার থেকে পরিত্রাণের মাস এই রমজান। নিজের সঙ্গে একান্তে কথা বলার মাস রমজান।
ময়লা পোশাক ডিটারজেন্টে রাতভর ভিজিয়ে রেখে কাচলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত ময়লা উঠে যায়। ঠিক তেমনই রোজা রেখে স্রষ্টার করুণা ও অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করলে মনোরাজ্যে তার ভিন্ন অনুভূতি হয়। সে-অনুভূতি এক স্বর্গীয় আনন্দ দেয়। ব্যক্তিকে বিনয়াবনত করে। অতি বদরাগী ও মুখর মানুষও রোজায় (Roza) নরম আচরণ করেন। এর প্রতিফলন মুসলিমদের মধ্যে ষোলো আনা পাওয়া না গেলেও আজও ১০ আনা দেখা যায়।
আরও পড়ুন: বিশ্বমঞ্চে সাফল্য বাংলার পর্যটনের
এই মাসে সম্পন্ন মুসলিমরা অনেক বেশি দান করেন। হাত তুলে নিজেদের অপরাধের জন্য ক্ষমা চান। তবে রমজান শেষ হতেই অধিকাংশই ফিরে যান সেই পুরাতন দিনলিপিতে। রমজানের এক মাসে এই তীব্র ত্যাগ-তিতিক্ষা সেখানে তেমন প্রভাব ফেলে না। আবার সেই অসংযম। সেই মিথ্যাচার-প্রবঞ্চনা, শঠতা ও কপটতা। সাধারণ মানুষের যা যা কুপ্রবৃত্তি থাকে তার অনুশীলন শুরু হয়ে যায়। এর তুলনা হতে পারে অমনোযোগী পড়ুয়ার সঙ্গে। পরীক্ষা এগিয়ে এলে সে রাতভর জাগে। কোনওমতে পাশ করার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে কখনও কখনও অসততারও আশ্রয় নেয়। কিন্তু তবু অনেকেই ফেল করে। পরীক্ষা না এলে তারা জেগে ওঠে না। আবার পরীক্ষার পর সেই একই অবস্থা। পড়াশুনা লাটে।
আসলে ধর্মও অধ্যয়নের মতোই বিরতিহীন অনুশীলন। রোজাকে (Roza) নিজের মনে করে ভাবলে তা বোঝা হয় না। কিন্তু রোজাকে কেবল পানাহার-বর্জিত কঠিন উপাসনা মনে করলে তাতে স্বর্গীয় আনন্দ মেলে না। সারাদিন কিছু খাইনি, এই বোধ রোজাকে কঠিন করে তোলে। তখন রোজা রাখার আনন্দকে ছাপিয়ে যায় রোজা খোলার আনন্দ। ত্যাগের থেকে ভোগের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। রোজা খোলার আনন্দ পূর্ণতা পায় রোজা রাখার ভিতরেই। এই বোধখানি জরুরি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনে বহুকিছু বদলায়। ধর্মের ব্যবহারিক দিকেও সে-বদল এসেছে। আগে ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে জন্মদিন পালনের এমন হিড়িক ছিল না। কিন্তু মা-বাবা ঠিকই মনে রাখতেন সন্তানের জন্মদিন। ঘরোয়াভাবে হয়তো একটা অনুষ্ঠানও হত। কিন্তু আজকাল সন্তানের জন্মদিন যতটা না আনন্দের তার থেকে বেশি চাপের হয়ে উঠেছে অভিভাবকের কাছে। কারণ ছেলের বন্ধুর জন্মদিনে তার বাবা যে এলাহি খরচ করেছেন তা তাঁর নেই। অথচ তা দেখাতে হবে! ছেলে বায়না ধরেছে। স্ত্রী অভিমান করছেন। ধার করেও বাবা সন্তানের জন্মদিনে ভূরিভোজ করাচ্ছেন। ফলে সন্তানের জন্মদিনের সেই আনন্দ তাঁর কাছে চাপের হয়ে ওঠে। ধর্মের ক্ষেত্রেও বহু কিছুকেই আমরা এমনই লোকদেখানো করে নিয়েছি। বহুকিছুকে সামাজিক ও লৌকিক করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিকতার টুঁটি টিপে ধরেছি।
আজকাল ‘ইফতার পার্টি’ নামক শব্দবন্ধ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। এটি একপ্রকার অনুষ্ঠান। সেখানে সন্ধ্যার খানাপিনাটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। রোজা (Roza) রাখেননি এমন মানুষও এমন পার্টিগুলিতে ভিড় করেন। সামাজিক ও সম্প্রীতির অনুষ্ঠান হিসেবে এর যে দু-আনাও গুরুত্ব নেই সে-কথা বুক ঠুকে বলা যাবে না। তবে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যে তার ১৬ আনা যোগ নেই এ-কথাটি খাঁটি। এখানে ইফতার-সামগ্রিক বাহুল্য-প্রবল। লোকে এখানে খাবারের গুণ বিচার করেন। হাতে সময় পেলে সামাজিক ও রাজনৈতিক কথাবার্তাও হয়ে যায়। মূলত সেক্ষেত্রে এটি একটি সান্ধ্যকালীন পার্টির রূপ নেয়।
যাঁরা একমাসের রোজাকে বাকি ১১ মাসের চালিকাশক্তি হিসাবে কাজে লাগাতে চাইছেন, তাঁদের রোজার তুলনা সেই মেধাবী পড়ুয়ার মতো। স্টেজে মেরে দেওয়া যার ধাতে নেই। সে বছরের পর বছর বহু কিছু ত্যাগ করে তবে টপার হয়েছে। যাঁরা সত্যি স্বর্গীয় আনন্দের জন্য রোজা রাখবেন, তাঁদের কাছে সান্ধ্যকালীন ইফতার কিংবা নৈশকালীন সেহরি নেহাতই গৌণ বিষয়। তেমন রোজা-রাখা মানুষ যে নেই তা নয়। কিন্তু মুশকিল হল, রোজার কথা হলেই লোকে ইফতার এবং সেহরি নিয়ে কথা বলেন। খাবার নিয়ে কথা হয়। মনে হতে পারে রোজাও বুঝি কোনও অনুষ্ঠান! কিন্তু রোজা কোনও অনুষ্ঠান নয়। রোজার একমাসের কঠিন সংযম শেষ হয় ইদের খুশিতে। যিনি রোজা রাখেননি তিনি বাকিদের সঙ্গে ইদের উৎসবে শামিল হতে পারেন, কিন্তু ইদের খুশি ছুঁতে পারা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অধ্যাত্মহীন ধর্ম প্রেমহীন দাম্পত্যের মতো। সেখানে সংসারটা হয়তো চলে যায় কিন্তু তাতে আনন্দ থাকে না। তাই রোজাকে যাঁরা মনোরাজ্যে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে জুড়তে পারছেন না তাঁরা আসলে রোজার আনন্দ থেকে বঞ্চিত।
ত্যাগের আনন্দ স্থায়ী হয়। ভোগের আনন্দ নতুন করে ভোগ করতে অনুপ্রাণিত করে। সামনে রোজা এই অনুভূতিকে যাঁরা জোরদার করতে পারবেন, তাঁরা মনে স্বর্গীয় আনন্দ পাবেন আশা করা যায়। যার পরিণতিতে তাঁরা লাভ করবেন পরম স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ।