রমজান (Ramadan)। আরবি ক্যালেন্ডার তথা হিজরি সনের একটা মাস। এই মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ‘রোজা’ বা উপবাস করেন একমাস। রাত্রি শেষ থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত কোনও খাদ্যদ্রব্য, পানীয়, ধূমপান করেন না। রতিক্রিয়ায় বিরত থাকেন। তবে অসুস্থদের ক্ষেত্রে ছাড় আছে। রমজান শব্দটির অর্থ ‘পুড়িয়ে ফেলা’। সমস্ত গ্লানি, হিংসা, দ্বেষকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সমস্ত ব্যর্থতাকে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিতে হবে। ‘আত্মশুদ্ধ’ হতে হবে। রমজানকে সে কারণেই ‘আত্মশুদ্ধি’ ও সংযমের মাস বলা হয়। ‘রোজা’ শব্দটি ফারসি। আরবি হচ্ছে ‘সিয়াম’। মুসলমানদের মধ্যে ‘জাকাত’ দেবার ধর্মীয় নিয়ম আছে। আয়কর দেবার মতো। মোট উপার্জনের আড়াই শতাংশ দিতে হবে রমজান মাসে। সেই পথ ধরে রোজা বা উপবাসকে বলা হয় শরীরের ‘জাকাত’। উপবাসের মধ্যে আমাদের শরীরে ও মনে যত কালিমা ও আবর্জনা জমা হয় তাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এ কারণেই বলেছেন— ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে— আগুন জ্বালো।’ আরবি মাসগুলো চাঁদ-এর গণনায় নির্ধারিত হয়। কোনও মাস ৩০ দিনের বেশি হবে না। আবার ২৯ দিনের কম হবে না। ফলে বছরের হিসাবে ইংরেজি ও হিজরি সনে কিছুটা পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্যের কারণে রমজান বা রোজার মাস কখনও শীত কালে, কখনও বা ঘনবর্ষায় আবার প্রচণ্ড গ্রীষ্মকালে। এ ছাড়াও সারা পৃথিবীতে রোজার সময় এক নয়। কোথাও কোথাও ১৮/১৯ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হয়। তবুও পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমানের কাছে খুশির বার্তা নিয়ে আসে। কোটি কোটি মুসলমান উন্মুখ হয়ে থাকে ‘রমজান’কে বরণ করে নেবার জন্য। হিজরি সনে ১২টি মাস। মুসলমানদেরও জিজ্ঞাসা করলে সবগুলো বলতে পারবে না আমাদের বাংলায়। কিন্তু দু’টি মাসের নাম তারা ভুলে যায় না। রমজান (Ramadan) ও মহরম। ইসলামি ক্যালেন্ডারের আর একটা বৈশিষ্ট্য— সন্ধ্যা লাগলেই নতুন দিন শুরু হয়ে গেল। রাত ১২ বাজার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এই মতোই হিসাব হয়। বাঙালি মুসলমানদের উপলব্ধির কথাই বলি। উৎসবের মেজাজে রমজান পালিত হয়। রমজান অর্থাৎ রোজা পালনে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কম। কোনও কোনও জায়গায় দেখেছি গ্রামের সব রোজদার মানুষ যার যা খাবার তা নিয়ে স্থানীয় মসজিদে আসছেন। সেখানেই ইফতার। তারপর নামাজ। বাড়ি ফেরা। এখন ইফতার পার্টির চল হয়েছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, প্রশাসনের পক্ষ থেকে রোজদার-সহ অন্যদেরও আহ্বান করা হয় ইফতারের জন্য। তাতে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যোগ দেন। এর পিছনে যেটা কাজ করে তা হল, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো। যাঁরা রোজা করছেন তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা। আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি, এই সহমর্মিতা ও ভালবাসা প্রদর্শনের জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সঙ্গে ইফতার পর্বে যোগ দিতে। জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতারা এটা করেন। রমজান যে সংযমের বার্তা দেয়। সেই বার্তাকে সম্মান জানানো এবং নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করাটাও এই মিলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
‘উপবাস’ বাঙালি জীবনে বিরল ঘটনা নয়। আমাদের বাঙালি পরিবারের মা-বোনেরা নানা ব্রত পালন করেন। জল পান করেন। কখনও তাও করেন না। নিরম্বু উপবাস। সেগুলোও সংযম রক্ষার কারণেই। কিন্তু রমজানের উপবাস-রোজা একেবারেই নিরম্বু। কোনও খারাপ কাজ করা যাবে না। ঝগড়াঝাঁটি করা যাবে না। কুচিন্তা ত্যাগ করতে হবে। এই মাসে সাধ্যের বাইরে গিয়েও দান-ধ্যান করতে হবে যাতে সবার জন্য রমজান অর্থবহ হয়ে ওঠে। সেই যে বলেছিলাম রমজান মানে ‘পুড়িয়ে ফেলা’।
এ-ব্যাপারে আমার মা’কে নিয়ে একটা ঘটনা আছে। যা প্রায় গল্পের মতো। মায়ের একটা বড় অপারেশন হয়েছে। ২/৩ মাস পর রমজান। শুরুর আর এক সপ্তাহ বাকি। মা নিদান দিলেন তিনি রোজা রাখবেন। আমরা খুবই আশঙ্কার মধ্যে পড়লাম। সারা দিনে এক গাদা ওষুধ খেতে হয় তাঁকে। কী করে হবে! আবার যদি অসুবিধায় পড়েন! মা নাছোড়বান্দা। তিনি ভাল আছেন। তিনি রোজা করবেন। কেউ তাঁকে থামাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া হবে। মা নিজেই গেলেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে। সব শুনে ডাক্তার হেসে বললেন, ‘রোজা রাখুন কিচ্ছু হবে না। সেহরি খাবার পর দিনের ওষুধগুলাে সব খেয়ে নেবেন একসঙ্গে। দেখবেন রোজা শেষে এত ওষুধ লাগবে না।’ বিজয়িনীর বেশে হাসতে হাসতে আমার মা বেরিয়ে এসেছিলেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে। এই জন্যই বোধহয় হাদিসে বলা আছে ‘মায়ের পায়ের নিচে বেহেস্ত।’ আমার মা জান্নাতবাসী হয়েছেন।
রমজান (Ramadan) মাস রোজা পালন ছাড়াও আর একটা কারণে মুসলমান তথা বিশ্বের সব মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মাসেই পবিত্র কোরান নাজেল হয়েছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ কোরান। কিন্তু সমস্ত মানব জাতিকে মুক্তির পথ দেখাতে কোরান অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। এখনও করছে। সমগ্র মানবজাতির মুক্তির চাবিকাঠি হল পবিত্র কোরান।
রমজান (Ramadan) সেইসব কারণে যেমন মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমন সব ধর্মের মানুষের কাছেও তাই। বাংলায় বিগত কয়েক বছরে একটা নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সন্ধ্যাবেলায় রোজা শেষে দেখা যায় বাস থেকে যাত্রী নেমে ইফতার করছেন। যাঁরা রোজা নেই তাঁরা ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এই শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা বাংলার অলঙ্কার ও সৌন্দর্য। আমাদের এটা রক্ষা করতে হবে। আমি ট্রেনে দেখেছি শুধু জল খেয়ে ইফতার করলেন একজন। সঙ্গে কোনও খাবার নিতে পারেননি। হঠাৎ পাশ থেকে এক বৃদ্ধা— বলা নেই কওয়া নেই— নিজের পুঁটুলি থেকে মিষ্টি, কলা বের করে দিলেন। আমরা অবাক। কিন্তু এটাই বাংলা। আমাদের সোনার বাংলা।
সোনার বাংলাকে বিপথে যারা চালিত করতে চায় তাদের ভাল হবে না এটা বাংলার মানুষ জানে। আসুন, সংযমের মাসে সমস্ত মালিন্য পুড়িয়ে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরি।