সত্যটা ছিল এই রকম। সাগরিকা চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে হয় জিওফিজিসিস্ট অনুরূপ ভট্টাচার্যের। ২০০৭-এ নরওয়ে পাড়ি দেন তাঁরা। এক বছরের মাথায় তাঁদের প্রথম সন্তান অভিজ্ঞানের জন্ম। প্রথমে বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে অভিজ্ঞানের অটিজমের লক্ষণ। ২০১০-এ ছেলেকে ফ্যামিলি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করেন অনুরূপ-সাগরিকা। ইতিমধ্যে জন্ম নেয় তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান, কন্যা ঐশ্বর্য। দেশটা নরওয়ে হলেও আর পাঁচটা বাঙালি-বাড়ির মতোই চলছিল সংসার। দুই ছেলে-মেয়ে সামলাতে হিমশিম সাগরিকা আর অনুরূপ ব্যস্ত নিজের কাজ ও নরওয়েতে স্থায়ী নাগরিকত্ব পাবার মরিয়া চেষ্টায়। মোটামুটি ছন্দেই চলছিল জীবন। আচমকা এক অচেনা বিপর্যয়। সাল ২০১১। নরওয়ের ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিস’-এর টিম এসে অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্যকে কেড়ে নিয়ে যায় তাদের মা-বাবার কাছ থেকে। নরওয়ে প্রশাসনের অভিযোগ ছিল, এই বাঙালি দম্পতি তাদের সন্তানদের যথাযথ যত্ন নিতে পারছেন না। কেন মনে হওয়া এরকম? কারণ তাদের ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিস’-এর সদস্যরা পরিদর্শনে এসে দেখে গেছেন, হাত দিয়ে ভাত মেখে বাচ্চাদের খাওয়ান সাগরিকা! বাবার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোয় অভিজ্ঞান! বাচ্চার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ মা একবার থাপ্পড়ও মেরেছিলেন ছেলেকে! যা কিছু আমাদের, মানে বাঙালি বাড়িতে অতীব সাধারণ তাই নরওয়ে প্রশাসনের চোখে অপরাধ! আর এসব ‘মারাত্মক’ অপরাধের কারণেই তাদের যুক্তি ছিল, সাগরিকা মানসিকভাবে অসুস্থ, সে দুটি বাচ্চা প্রতিপালনের যোগ্যই নয়, তাই রাষ্ট্র তাদের বাচ্চাদের দায়িত্ব নেবে ও দেখাশোনা করবে। পাগলের মতোই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন সাগরিকা, বাঙালি বাড়ির অতি-স্বাভাবিকতাগুলি, কিন্তু তারা বুঝতে চায়নি। অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের হেফাজতে রাখার জন্য।
এই হৃদয়-বিদারক কাহিনি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও মিডিয়া মারফত জনসমক্ষে আসে। নরওয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয় অনেকে, ‘রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট অপহরণ’ এবং তাদের ‘ফস্টার হোম’-এ বাচ্চাদের জমা করার প্রবণতা সামনে আসে গোটা বিশ্বের। শুরু হয় কূটনৈতিক চাপ, আইন, আদালত। দুই দেশের প্রবল টানাপোড়েনের পর শেষ অবধি নরওয়ে সরকার বাচ্চাদের কাস্টডি দিতে রাজি হয় অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যের কাকা অরুণাভাস ভট্টাচার্যকে। কিন্তু ঘটনা এখানেও থেমে থাকেনি। থামেনি মা সাগরিকার লড়াই। বরং শুরু হয়েছিল নতুন করে। কারণ বাচ্চাদের নিয়ে এই দীর্ঘ লড়াইয়ের মাঝপথে মনোমালিন্য ও মতানৈক্যের কারণে তার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল। কাজেই বাচ্চাদের নিজের হেফাজতে পেতে দেশে এসে শুরু হয় আরেক প্রস্থ আইনি লড়াই। শেষ অবধি কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে বাচ্চাদের কাকা ও দাদুর কাছ থেকে সন্তানদের নিজের হেফাজতে পান সাগরিকা। শুরু হয় এক সিঙ্গল মাদারের জার্নি। সেটা ২০১৩। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা সাগরিকা তাঁর বই ‘আ জার্নি অফ আ মাদার’ বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন। যার আধারেই পরিচালক অসীমা ছিব্বর তৈরি করেছেন তাঁর ছবি, ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ (Mrs Chatterjee Vs Norway)।
আরও পড়ুন: পিকের নামাঙ্কিত জিমন্যাসিয়ামের উদ্বোধনে চমক অমল দত্তকে নিয়েও
সাগরিকা সিনেমায় হয়েছেন ‘দেবিকা’। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন রানি মুখোপাধ্যায়। অনুরূপ হয়েছেন ‘অনিরুদ্ধ’, অভিনয়ে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। যেহেতু ঘটনাবলি কম-বেশি সবার জানা, অর্থাৎ সিনেমার ‘গল্প’ অনেকটা জেনেই দেখতে যাওয়া তাই পরিচালকের দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। এ ছাড়া সত্য ঘটনাকে ছবিতে তুলে ধরার আরও হাজার বায়নাক্কা। এসব ক্ষেত্রে ছবির গুণাগুণের চেয়ে নজর বেশি থাকে ঘটনার ত্রুটি-বিচ্যুতি খোঁজার দিকে। সেই সঙ্গে বাস্তবের চরিত্রদের ব্যক্তিগত মতামত, অভিযোগ, অনুযোগ তো রয়েইছে। তবে সেসব ঢেকে দিতে পেরেছেন অনেকটাই রানি-অনির্বাণ, তাঁদের অভিনয় গুণে। যদিও এ ছবি একান্তই রানির। প্রায় প্রতি ফ্রেমে রানি। একজন সন্তান-বিচ্ছিন্না মায়ের আকুতি, লড়াই, প্রতি পদক্ষেপে টানাপোড়েন— সবটা রানি অনবদ্য ফুটিয়ে তুলেছেন তো বটেই, সেই সঙ্গে একেবারে ঘরোয়া দৃশ্যগুলিতেও তিনি অসাধারণ। নব্বইয়ের দশকে মেনস্ট্রিম নায়িকা হিসেবে যাঁর আবির্ভাব, সেই তিনি নিজেকে ভেঙে চুরে একজন অভিনেত্রী হিসেবে যেভাবে ধাপেধাপে প্রতিষ্ঠা করেছেন তা এককথায় নিদর্শন। যোগ্য সঙ্গত করেছেন অনির্বাণ। পর্দায় ক্রমপর্যায়ে ‘খারাপ মানুষ’ হয়ে ওঠা আর একবার বুঝিয়ে দেয় তিনি কোন দরের অভিনেতা। বাঙালি দম্পতির কাহিনি বলেই অসীমা দুই বাঙালি অভিনেতাকে নির্বাচন করেছেন বুদ্ধি করেই। তবে এত শক্তিশালী অভিনেতাদেরও যদি আরেকটু বুদ্ধি করে ব্যবহার করতেন, দর্শকের পাওনা হত বেশি। আবেগ কোনও কোনও জায়গায় মেলোড্রামার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে চিত্রনাট্যের কারণে। ল’ইয়ারের চরিত্রে জিম সরভ দুর্দান্ত। সব মিলিয়ে ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ (Mrs Chatterjee Vs Norway) দর্শকদের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে।
তবে এই ছবি কেন্দ্র করেই সাগরিকা-অনুরূপের পুরনো তিক্ততা প্রকাশ পাচ্ছে ফের। পরস্পরের বিরুদ্ধে পুষে রাখা রাগ-অভিমান-অভিযোগ ছিটকে বেরোচ্ছে। অনুরূপ এখনও নরওয়েতেই। সাগরিকা দেশে। দুজনে আলাদা থাকলেও এখনও আইনত তাঁদের বিচ্ছেদ হয়নি। তবে সাগরিকা বর্তমানের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এড়াতে দ্রুত বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন।