বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় উদযাপিত দিবসের মধ্যে ১ এপ্রিল একটি। এটি মানুষকে ‘বোকা’ বানানোর দিন। যাঁরা বোকা বনে যান, তাঁদের বলে ‘এপ্রিল ফুলস’। এত বছর ধরেও এই দিনটির জনপ্রিয়তাতে ভাটা পড়েনি। যেমন বিশ্বজুড়ে যত গান রয়েছে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ তার মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয়। ১৮৯৩ সালে কিন্ডারগার্টেনের জন্য প্রকাশিত একটি বইয়ে ছিল ‘গুড মর্নিং টু ইউ’বলে একটি গান। গানটি লিখেছিলেন স্কুল শিক্ষিকা মিলড্রেড জে হিল। তাঁর বোন প্যাটি স্মিথ এই গানের কথাগুলি বদলে দিয়ে লিখেছিলেন ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’। ১৯৯৮ সালের ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ অনুযায়ী, ইংরেজি ভাষায় সব চেয়ে জনপ্রিয় গান ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’।
আরও পড়ুন-ব্যর্থ ব্যাটিং, হারেই শুরু নাইটদের
হ্যাপি বার্থে ডে গানটির হদিশ মিললেও বোকা বানানো দিবস অর্থ এপ্রিল ফুলের সঠিক ইতিহাস কিন্তু মেলে না। নানাভাবে এটিকে নানাজন ব্যাখ্যা করেছেন। সেই হিসাবে সার্বিক গ্রহণযোগ্য কোনও ইতিহাস এক্ষেত্রে নেই। তার বদলে রয়েছে নানা ঘটনা। কিছু মজার। কিছু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবে ইতিহাসের কষ্টিপাথরে কোনও গল্পই ষোলোআনা খাঁটি প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তারপরও দিবসটি পেয়েছে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা।
আরও পড়ুন-কলকাতায় দুয়ারে সরকার
১ এপ্রিল ‘এপ্রিল ফুল’ দিবস হিসাবে বিশ্বের বহু দেশেই পালিত হয়। এর পিছনের ইতিহাস যাই থাকুক না কেন, মানুষ এই দিনটিকে নিছক দুষ্টুমি দিবস হিসাবে গ্রহণ করেছে। এদিন মানুষ মানুষের সঙ্গে মজা করে। যেহেতু সমস্ত মজা ও রসিকতা কম বয়সেই বেশি উপভোগ্য তাই তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীদের কাছে দিনটি ভীষণ প্রিয়।
বাঙালিদের এপ্রিল ফুলের কিছু সাধারণ উদাহরণ দেওয়া যেতেই পারে। হাজব্যান্ডের হাতে টিফিন বক্স দেবেন, কিন্তু তাতে খাবার থাকবে না, থাকবে কেবল চিরকুট। খিদের সময় টিফিন খুলে আপনার হাজব্যান্ড দেখবেন পড়ে আছে একটি চিরকুট। তাতে লেখা আজ এপ্রিল ফুল। তিনি মনে মনে আপনার উপর রাগ করবেন ঠিকই, একই সঙ্গে হাসবেনও।
আরও পড়ুন-অভিনেত্রী পল্লবীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লোপাট
গ্রামে-গঞ্জে খানিক মোটা দাগের রসিকতাও হয়। কেউ হয়তো পান চাইল, তার পানের ভিতর দিয়ে দেওয়া হল কাঁকর। কারও শরবতে হয়তো দেওয়া হল নুন। শিক্ষকদেরও ছাড় দেওয়া হত না। সেজে গেঁথে তাঁদের ঠকানো হত। ভয়াবহ বিষয় ছিল যে তাঁদের অনেকের চেয়ারের নিচে ওদিন রাখা হত মার্বেল। বসলেই যেন মাস্টারমশায় হড়কে যান। কিন্তু ঠেকে শেখা মাস্টারমশাইরা বেশিরভাগ সময়ই সাবধানে থাকতেন। অনেক সময় মাস্টারমশায়রা পড়ুয়াদের কচি মুখে আনন্দের আভাস দেখার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ঠকতেন। পরে পড়ুয়ারা দলবল মিলে চাঁদা তুলে মাস্টারমশায়দের মিষ্টি খাওয়াত। সেসব নেই। আজকের দিনে ছেলে-বুড়ো সবাই এমনিতেই প্রাঙ্ক ভিডিওর রিল দেখে হেসে খুন। সেজে গেঁথে এপ্রিল ফুলের সেই নিছক মজার দিন আজ আর সেইভাবে নেই। তাতে অবশ্য দিনটির জনপ্রিয়তা কমেনি।
আরও পড়ুন-নিউ গড়িয়া মেট্রো রুটে ভাড়া ঘোষণা
মুসলিমরা অনেকেই এপ্রিল ফুলের আনন্দে মেতে ওঠেন না। বরং তাঁরা অনেকেই এর বিরোধী। এই বিরোধিতার দুটি কারণ।
একটিকে তাঁরা ঐতিহাসিক মনে করেন, অন্যটি ধর্মীয়। মুসলিমরা অনেকেই বিশ্বাস করেন ১ এপ্রিল ইসলামের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
চার খলিফার শাসনকাল শেষ হলে, উমাইয়া বংশের উত্থান ঘটে ৬৬১ সালে। তাঁদের হাত ধরে মুসলিম শাসনের ভিত্তি আরও মজবুত হয়। আসতে থাকে একের পর এক বিজয়। ইসলামের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে। প্রায় ৭০০ বছর স্পেন ইসলামের পতাকাতলে ছিল। কিন্তু তারপর ধীরে তাতে ক্ষয় শুরু হয়। আর যার পরিণতির সঙ্গে ১ এপ্রিলের সম্পর্ক রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
আরও পড়ুন-এমএলএ কাপের উদ্বোধন
অনেকেই মনে করে থাকেন, ১৪৯২ সালে রাজা ফার্দিনান্দ স্পেনের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাডায় হামলা করেন। এসময় ফার্দিনান্দ শহরের আশপাশের সকল শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। ফলে শহরের মারাত্মক খাদ্য সংকট নেমে আসে এবং অচিরেই সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষ যখন মারাত্মক অবস্থায় তখন রাজা ফার্দিনান্দ ঘোষণা করেন যে, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দিয়ে নিরস্ত্রভাবে মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে তাদেরকে বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেওয়া হবে। এসময় দুর্দশাগ্রস্ত লাখ লাখ নারী ও পুরুষের কথা ভেবে খুলে দেওয়া হয় শহরের প্রধান ফটক এবং মুসলমানরা নিরস্ত্রভাবে শহরের মসজিদগুলোতে আশ্রয় নেয়। এসময় খ্রিস্টান সৈন্যবাহিনী শহরে প্রবেশ করে মসজিদগুলোতে তালা আটকে দেয় এবং শহরের প্রত্যেকটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। এঘটনায় লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারী ও পুরুষ মর্মান্তিকভাবে মসজিদের ভেতর প্রাণ হারায়। এভাবে মুসলমানদের সহজভাবে বোকা বানানোর ঘটনাকে ‘এপ্রিল ফুল’ হিসেবে পালন করার রীতি চালু করে খ্রিস্টান দেশগুলোতে।
আরও পড়ুন-বিমানকর্মীর সঙ্গে অশালীন আচরণ, গ্রেফতার সুইডিশ যাত্রী
যদিও বিষয়টি নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। মুহাম্মদ তারিক গাজী নামের কানাডার একজন সাংবাদিক এবং ইতিহাসবিদ ‘এপ্রিল ফুল’ নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখার শিরোনাম- Truth About April Fool’s day and Muslim Representative Method of Scientific Inquiry. সেখানে তিনি জানিয়েছেন, স্পেনে মূরদের শাসনের পতন হয় ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি (১ এপ্রিল নয়)। এছাড়াও বিখ্যাত গবেষক ফিরাস আল-খাতিব তার ‘Lost Islamic History: Reclaiming Muslim Civilization from the Past’ বইয়ে গ্রানাডার পতনের তারিখ ১ জানুয়ারি ১৪৯২ (পৃষ্ঠা ১০২) লিখেছেন।
Joseph F. O’Callaghan এর ‘A History of Medieval Europe’ বই থেকে উদ্ধৃত করলে আমরা দেখতে পাই: “১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি ইসাবেলা আর ফারদিনান্দ গ্রানাডায় প্রবেশ করলেন। সেদিন তারা গ্রানাডার শাসক দ্বাদশ মুহাম্মাদের কাছ থেকে গ্রানাডার চাবি নেন।”
B.B Synge তার ‘Brave Men and Brave Deeds’ আর্টিকেলে লিখেন- “আবু আব্দুল্লাহ (মুহাম্মাদ দ্বাদশ) জানুয়ারির দুই তারিখ (১৪৯২) আত্মসমর্পণ করেন।”
আরও পড়ুন-আধার না থাকলেও মিলবে রেশন
সালমা খাদ্রা জায়ূসি সম্পাদিত ‘The Legacy of Muslim Spain’ বইয়ে Vincent Barletta তার আর্টিকেল ‘About the Moriscos’ এ লিখেন, “ক্যাথলিক যাজকরা দীর্ঘ আটশো বছর পর ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রানাডা পুনরুদ্ধার করে।” অর্থাৎ বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ, গবেষকরা একমত যে, গ্রানাডায় মুসলিমদের (মূর) পতন হয় ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ (অথবা এর আগেরদিন)। এই পতনের সঙ্গে ১ এপ্রিলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই।
আরও পড়ুন-কলকাতায় দুয়ারে সরকার
ধর্মীয় দিক দিয়ে এপ্রিল ফুল মুসলিমদের জীবনবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তা মুসলিমদের বিশ্বাস ও কর্মের সঙ্গে যায় না। এই দিন মিথ্যা বলে মানুষকে বোকা বানানো হয়। একজন আরেকজনকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে এবং তাকে সবার সামনে ‘অপদস্থ’ করে। হজরত মুহাম্মদ (সা ) মিথ্যা সম্পর্কে হাদিসে ঘোষণা করেন-‘তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ এ মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।’ (বুখারি)
‘সে ব্যক্তির ধ্বংস অনিবার্য যে ব্যক্তি মানুষের মাঝে মিথ্যা কথা বলে দুষ্টুমি বা মজা করার জন্য।’ (আবু দাউদ)
‘যে ব্যক্তি কারও সঙ্গে প্রতরণা করল সে আমার উম্মত হতে পারে না।’ (মুসলিম)