আমরা পছন্দ করি বা না করি, ঘরে ঘরে প্লাস্টিকের মোড়ক হু হু করে ঢুকে পড়ছে। কাপড় বা চটের থলি হাতে বাজারে গেলেও এর হাত থেকে রেহাই নেই। চাল ডাল নুন তেল সবই কিন্তু এখন পাওয়া যায় প্লাস্টিকের প্যাকেটে। বিস্কুট, চানাচুর, নানান ধরনের ভুজিয়া ইত্যাদি মুচমুচে রাখতে রুপোলি আস্তরণ দেওয়া সুদৃশ্য রঙিন নানা মাপের প্যাকেটে ঝোলানো থাকে ছোট-বড় সব দোকানেই। ফলের রস চাইলে তাও পাওয়া যাবে রুপোলি আস্তরণে মোড়া টেট্রা প্যাকেটে। অতএব গৃহকোণের জঞ্জাল ফেলার পাত্রটি উপচে পড়ে ঘরগৃহস্থালির বিবিধ বাতিল জিনিসপত্রে।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সূচনা পর্বেই পৃথকীকরণের (segregation at source) কথা বলা হয়। এইসব বর্জ্য এক জায়গায় জমা না করে আলাদা আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক লাভ।
আনাজপাতির খোসা, প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, কাচ বা বাতিল লোহা-লক্কড় ইত্যাদি একটু আলাদা করে গুছিয়ে রাখতে হবে। এই ভাবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার (solid waste management) প্রাথমিক ধাপ সহজেই পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। কথাটা গুরুগম্ভীর শোনালেও সত্যি। কোন কোন এলাকায় কঠিন বর্জ্যকে আলাদা আলাদা করে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। যেখানে সে ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি সেখানে আমরা নিজেরা কি একটু এগিয়ে আসতে পারি না?
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় আমরা নিজেদের ঘরের আবর্জনা যদি একটু সচেতন ভাবে রোজ আলাদা করে রাখার বন্দোবস্ত করতে পারি তাহলে সহজেই অনেক দুরূহ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
রান্নাঘরের ভিজে সবজির খোসা, জঞ্জালের পাত্রে না ফেলে জৈবসার বানানো যায়। রোজ সবজি ও ফলের খোসা, চায়ের পাতা ইত্যাদি (এঁটো কাটা নয়) ও সমান পরিমাণে শুকনো পাতা বা কাঠের গুঁড়ো মিশিয়ে পুরনো বড় টব বা অন্য কোনও ছিদ্র যুক্ত পাত্রে খবরের কাগজ পেতে তাতে রাখতে হবে ঢাকা দিয়ে। মাঝে মাঝে নেড়েচেড়ে দিতে হবে। ভরে গেলে পাত্রটি অন্যত্র সরিয়ে রেখে আরেকটি পাত্র নিতে হবে। আড়াই-তিন মাসের মধ্যে দারুণ জৈব সার পাওয়া যাবে। আরও তাড়াতাড়ি সার পেতে হলে গাছের চারা বিক্রির দোকান থেকে একটু কেঁচো সার কিনে ওর সঙ্গে যোগ করলে আরও তাড়াতাড়ি সার তৈরি হবে। নিজে হাতে তৈরি করা সার দিয়ে গাছ বসানোর আনন্দই আলাদা। এই ব্যবস্থা ঘরে ঘরে চালু হওয়া খুব জরুরি।
আরও পড়ুন- বিএসএফের প্রহারে গ্রামবাসীর মৃত্যুতে গর্জে উঠল গীতালদহ
বর্তমান জীবনে প্লাস্টিক আমাদের জীবনচর্চার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে। তাই প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করতে আমাদের ব্যক্তিগত ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। জঞ্জাল ফেলার পাত্রে সবজির খোসা প্লাস্টিকের ঠোঙা বা বাতিল জিনিসপত্র একসঙ্গে ফেলা কোনওমতেই চলবে না। পাতলা পলিব্যাগ, প্লাস্টিকের পাউচ বা প্লাস্টিকের বোতল গুছিয়ে রেখে আপসাইক্লিং পদ্ধতিতে বাতিল প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করতে হবে। এই কাজ করতে একটু শৃঙ্খলাপরায়ণ হওয়া দরকার।
প্রতিদিন সংসারে অসংখ্য জিনিসপত্র বিস্কুট, চাল, ডাল, চিঁড়ে, মুড়ি থেকে শুরু করে চানাচুর, চিপস সবই সুদর্শন নানা জাতের প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঘরে ঢুকছে। প্যাকেটগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে সাবধানে খুলে আলাদা আলাদা জায়গায় গুছিয়ে রাখতে হবে। কেকের পিছনের পাতলা প্লাস্টিকের আস্তরণ, আইসক্রিমের কাপ, জল বা ফলের রসের বোতল সবই একটু গুছিয়ে রাখতে হবে যা প্রয়োজনমতো বাহারি জিনিসপত্র বানানোর কাজে লাগানো যাবে।
একটা বাতিল পেনের মাথায় টিফিন কেকের প্লাস্টিকের চৌকো বা গোল প্লাস্টিকের বাটি আটকে তার মধ্যে পলিব্যাগ গুঁজে ভরাট করে ও কালো পলিব্যাগ দিয়ে চুল বানিয়ে চট করে তৈরি করা যায় মিনি পাপেট। এটা পেলে ছোটদের মুখে হাসি ফুটবেই।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্কুল বা কলেজ প্রাঙ্গণ সাজানোর জন্য রঙিন কাগজ না কিনে আগে থেকে জমিয়ে রাখা রুপোলি আস্তরণ দেওয়া বিবিধ পলিপ্যাকেট থেকে রকমারি নকশা বানিয়ে সুন্দর করে সাজানো যেতে পারে।
অনুষ্ঠান শেষে সেগুলি বড় কালো প্লাস্টিক প্যাকেটে ঠেসে ঠেসে ভরে মুখ বন্ধ করে নোটিশ বোর্ড হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিবেশ সম্পর্কিত কোনও উদ্ধৃতিও দেওয়া যেতে পারে। অথবা বড় কোনও বিশালাকার মজার মুখ বানানো যেতে পারে।
বর্তমানে বেশিরভাগ এলাকাতেই বহুতল বিশিষ্ট হাউসিং কমপ্লেক্স ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সীমিত সংখ্যক হাউসিংয়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিদিনের রান্নাঘরের আনাজপাতির খোসা সংগ্রহ করে জৈব সার তৈরির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওই সার থেকে বাহারি গাছ তৈরি করে হাউসিং সাজানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি একটি অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ। একইভাবে প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে প্লাস্টিকের নানা মোড়ক সংগ্রহ করে বড় প্লাস্টিক প্যাকেটে ভরে বিশালাকার কোনও আকর্ষণীয় ভাস্কর্য তৈরি করা যেতে পারে।
পরবর্তী পর্যায়ে পাঠাতে হবে রিসাইক্লিংয়ের জন্য। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
আমাদের দেশের কৃষ্টির সঙ্গে কোনও বস্তুর পুনরায় ব্যবহারের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে অনেককাল আগে থেকে। তার বড় উদাহরণ হল, কাপড় বা ধুতি বহু ব্যবহারের পর শীতের ওম পেতে কাঁথা বানানোর চল বহুদিনের। পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে রঙিন সুতো বার করে সেই কাঁথায় নিপুণ হাতে দৃষ্টিনন্দন শিল্প সৃষ্টি করা হত। বর্তমানে ‘ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলো’ অর্থাৎ ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ আমাদের ঐতিহ্যের পরিপন্থী। চাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদার সংযম। সৃজনশীল সৃষ্টির মাধ্যমে বর্জ্য বস্তুকে শিল্প সমন্বিত ব্যবহার্য বস্তুতে রূপান্তরিত করার প্রয়াসে এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন করতে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এ ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা এখন প্লাস্টিক যুগে বাস করি। না চাইলেও ঘরে ঘরে হু হু করে প্লাস্টিক নানাভাবে ঢুকছে। পৃথিবীকে প্লাস্টিক দূষণ মুক্ত করতে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।