প্রায় এক যুগ আগের কথা।
বঙ্গে তখন বিরাজ করত এক দাম্ভিক ভদ্রলোকের শাসন। ক্ষমতার দর্প তাঁর মাথায় চড়ে গিয়েছিল। সেই দর্প-প্রভাবে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩৫।’ অস্যার্থ, সংখ্যার নিরিখে লঘুপক্ষ বিরোধীদের কথাবার্তা, দাবিদাওয়ায় বিশেষ পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।
বাংলার আমজনতা সেই দাম্ভিককে এমন শিক্ষা দিল, যে আজ তিনি একই বিষয়ে মুখ খুলতে গেলে বলতে বাধ্য হবেন, ‘আমরা শূন্য ওরা ২১৯+’।
সংখ্যার এই হিসাব বঙ্গ-বিধানসভায় বিধিসম্মতভাবে বহাল থাকার কথা ২০২৬ পযর্যন্ত। সংবিধান সেটাই বলে।
কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্য কথা বলছেন। গত ১৪ এপ্রিল সিউড়িতে এক প্রকাশ্য জনসভায় অমিত শাহ বলেছেন, বিজেপি যদি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ৩৫টা আসনও পায়, তাহলেই আর চিন্তা নেই।
২০২৫ সালের আগেই বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার একেবারে ‘কা-দা-দা-দা— ভুস’।
ঠিক জাদুকররা যে কায়দায় আবরাকাদাব্রা হোকাস-পোকাস বলতে বলতে উধাও করে দেন কোনও জিনিস, সেই ভোজবাজি দেখানোর কেতায় রাজ্যের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে একেবারে ‘ভ্যানিশ’ করে দেবেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (HM Amit Shah)।
২০২৫-এ তো রাজ্যে কোনও বিধানসভা নির্বাচন নেই। ২০২১-এ তৃতীয় বারের জন্য জনাদেশ পেয়ে বাংলার চালিকাশক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। সাধারণ পাটিগণিতের হিসাব মানলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রিত্ব শেষ হবে ২০২৬-এ। এর মধ্যে যদি ২০২৫-এই রাজ্যে পালাবদলের কথা বলেন, তবে বুঝতে হবে, সেই বদল সুস্থ স্বাভাবিক জানাদেশের বলে বদল নয়। সেই বদল স্বৈরতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক পরিবর্তন।
এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সন্দেহাতীতভাবে তেমন বদলের কথাই বলছেন। ২০২১-এ তিনি খোয়াব দেখতেন। ‘অব কি বার ২০০ পার’। সেবার বাংলার মানুষ বিজেপিকে মেরেকেটে ৭০টা আসন দিয়েছিল।
২০২৩-এ তিনি খোয়াব দেখাচ্ছেন, লোকসভার ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৫টা পদ্ম-প্রার্থী জিতলেই, বঙ্গে ফুল বদল অবশ্যম্ভাবী। অথচ নিজে ভালমতোই জানেন, আজকের দিনে সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ অবাধ নির্বাচন হলে বিজেপি মেরেকেটে দুই অংকের আসনও জোটাতে পারবে না।
আর সোজা সাংবিধানিক উপায়ে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আশা নেই বলেই ২০২৫-এ রাজ্যের নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন অমিত শাহ (HM Amit Shah)।
ইনি হলেন সেই অমিত শাহ যাঁর বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ ও রাহাজানির মামলা ছিল।
ইনি হলেন সেই অমিত শাহ ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় তিনি যে হলফনামা দাখিল করেন, তাতেই বলা হয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে চার-চারটি ফৌজদারি মামলা এখনও ঝুলছে।
ইনি হচ্ছেন সেই অমিত শাহ যাঁকে স্বরাষ্ট্র দফতরের কাজে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাঁকে যাঁকে বেছেছেন তাঁরা সবাই ‘এক সে বড়কর এক’ ‘ক্রিমিনাল’।
মোদিজি মহাদুষ্কৃতীকে সঙ্গত দেওয়ার জন্যই বোধহয় দুষ্কৃতীদেরই বেছেছেন। লখিমপুর খেরির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাংসদ, হাথরস-কাণ্ড খ্যাত অজয় মিশ্র টেনি তাঁদের অন্যতম। আর একজন হলেন নিত্যানন্দ রাই, যাঁর বিরুদ্ধে বেআইনি অস্ত্র নিয়ে সমাবেশ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো, তোলাবাজি-সহ বিভিন্ন ফৌজদারি অভিযোগ আছে। আর তৃতীয় জন হলেন আমাদের রাজ্যেরই সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক। একটা দুটো নয়, তেরোটা ফৌজদারি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খুনের অভিযোগ, বেআইনি অস্ত্র মজুতের অভিযোগ, ডাকাতি, রাহাজানি, মহিলাদের শ্লীলতাহানি, দাঙ্গাবাজি ইত্যাদি ইত্যাদি। অপরাধের এমন ‘রেকর্ড’ না থাকলে মোদিজির মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব জোটে না বোধ হয়।
নিজের দায়িত্ব দারুণভাবে পালন করছেন অমিত শাহ।
তাঁর অঙ্গুলিহেলনে রাজ্য জুড়ে ইডি-সিবিআই ভূতের নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। যথোপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী-বিধায়কদের বিরুদ্ধে বাতাসে খবর ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছেন তাঁরা।
উত্তরবঙ্গে বাংলা-বিভাজনের আগুন উসকে দেওয়া হচ্ছে।
হিসাব কষে হাওড়া ও রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো হয়েছে। এরকম ঘটনা যাতে রাজ্য জুড়ে অব্যাহত থাকে, রাজ্যে শান্তির পরিবেশ যাতে না থাকে, সেজন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রী ও ডোভালই দায়ী, বিস্ফোরক প্রাক্তন সেনাপ্রধান
সীমান্তবর্তী এলাকায় ভুয়ো আধার কার্ড খুঁজে বের করার নামে ঘুরিয়ে এনআরসি-সিএএ ইস্যুতে শান দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের যেসব এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি সংখ্যায় বাস করেন, সেইসব এলাকাগুলোতে ভুয়ো আধার কার্ড খুঁজে বের করার জন্য বিশেষ অভিযান চালাতে বলা হচ্ছে, যাতে ভোটের আগে বহু নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে।
একজন বড় গুন্ডার বহুমাত্রিক গুন্ডামির নমুনা হয়ে উঠছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কার্যক্রম।
দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। পুলওয়ামা-কাণ্ড নিয়ে সত্যপাল মালিকের বক্তব্যে বিপাকে মোদি সরকার। ওঁরা বেশ বুঝতে পারছেন, সাম্প্রদায়িক তাস খেলেও ভোটে বিশেষ সুবিধা হবে না। তাই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবিধানিক পদমর্যাদার কথা ভুলে রাজ্য সরকারকে ভেঙে দেওয়ার ছক কষছেন।
আমরা এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইস্তফা চাইছি।
‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩৫’-এর দাম্ভিকতার জুতসই জবাব দিয়েছিল বাংলা। বঙ্গ-বিধানসভায় সিপিএমের সদস্য সংখ্যা শূন্য।
‘আমরা ৩৫ ওরা বড়জোর ৭, তারপর রাজ্য সরকারটা ভেঙে দিলেই কিস্তিমাত’—এই হুমকির জুতসই জবাব দেওয়ার দিন গুনছে বাংলা।
দেওয়াল-লিখন ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে।