মঙ্গল পাণ্ডে রাজ্য বিজেপির ‘ধান্দাবাজি’ ধরে ফেলেছেন। পাণ্ডে কিন্তু দলের এলেতিলি কেউ নন। আরএসএসের দীর্ঘদিনের সংগঠক। বিহারে বিজেপির প্রথমসারির নেতা। সে রাজ্যের মন্ত্রীও ছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে। বর্তমানে তিনি বাংলায় দলের পর্যবেক্ষক। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বিজেপির কেন্দ্রীয় কর্তারা রাজ্য নেতৃত্বকে নির্দেশ দিয়েছেন, বুথ পর্যায়ে দলের সংগঠন মজবুত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে গেরুয়া শিবিরের ‘বুথ সনাক্তকরণ অভিযান’ চলছে। অভিযানের উদ্দেশ্য প্রতি বুথে ৩১ জন সক্রিয় কর্মী খুঁজে বার করে কমিটি গঠন। যাদের মধ্যে থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী এবং বুথ এজেন্ট ঠিক করবে বিজেপি। প্রথম পর্বের অভিযান হয় ১২ থেকে ২৬ মার্চ। শেষ দিন জেলাওয়ারি এই কর্মসূচির অগ্রগতি নিয়ে দলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে। বৈঠকে রিপোর্ট দেওয়া হয়, ৩০ শতাংশ বুথে পৌঁছনোর চেষ্টা হলেও, ৩০ শতাংশের বেশি বুথে বিজেপি কিছু করতে পারেনি। আর প্রায় ৪০ শতাংশ বুথ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হওয়ায় সেসব জায়গাতেও বিজেপির অগ্রগতি নেই বললেই চলে। কিন্তু রাজ্যে ৭৮ হাজার বুথের মধ্যে যে ৩০ শতাংশে তারা পৌঁছেছেন, এটাই মানতে চাননি মঙ্গল পাণ্ডে। বৈঠকে উপস্থিত রাজ্য এবং জেলা নেতা-নেত্রীদের মুখের ওপরই তিনি বলে দেন, ‘এর মধ্যে কতটা জল মেলানো আছে? আগেও আপনারা তো এরকম অনেক রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবে কি কিছু মিলেছে? ‘ শুধু প্রশ্ন তোলাই নয়, মূলত মঙ্গল পাণ্ডের পরামর্শেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ফের ‘বুথ সনাক্তকরণ অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দিয়েছে। ১৬ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযান। চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। দলের এই নেতাদের দেওয়া তথ্যে নির্ভর করেই তো বিগত বিধানসভা নির্বাচনে অমিত শাহ বাংলায় প্রচারে এসে বলেছিলেন, ইস বার ২০০ পার! ফলাফলে দেখা গেল, বিজেপি পগাড় পার!
বিজেপির অন্দরে এই হাল হকিকৎ জানাতে হল একটিই কারণে। সেটা হল, দেশের মহাশক্তিমান’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এরাজ্যে এসে কয়েকদিন আগে বলে গিয়েছেন, ‘লোকসভায় বাংলার থেকে বিজেপি ৩৫টি আসন পেলে, তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার চলে যাবে। ‘ অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাচ্যুত হবেন। সঙ্গে সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এর একটা দিক, সাংবিধানিক। আর অন্য দিকটি হল, সাংগঠনিক। দেশের সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) কি প্রকাশ্যে এভাবে কোনও আঞ্চলিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ‘হুমকি’ দিতে পারেন? এরকম কোনও ক্ষমতা কি সংবিধান অমিত শাহকে দিয়েছে? সঙ্গত কারণেই মুখ্যমন্ত্রী দাবি তুলেছেন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (Amit Shah) উচিত পদত্যাগ করা। আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সঙ্গী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) সম্পূর্ণ স্বৈরচারী শাসকে পরিণত হয়েছেন। কোনও বিরোধী নেতা নেত্রীর রেহাই নেই। তাঁদের সমালোচনা করলেই পিছনে লেগে যাবে সিবিআই কিংবা ইডি। কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে বিজেপির শাখা সংগঠনে পরিণত করা হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে এ এক নজিরবিহীন অবস্থা। কিন্তু কোনও দেশে শাসকশ্রেণি এরকম বল্গাহীন ভাবে ক্ষমতা অপব্যবহার করে চিরকাল কি টিকে থাকতে পেরেছে? না। মোদি-শাহও পারবেন না। জনগণের আদালতেই তাদের বন্দী হতে হবে।
বাংলায় তারা লোকসভা ভোটে ৩৫টি আসন পেতে পারে, এটা বিজেপির কোনও সাধারণ কর্মী বিশ্বাস করে? অমিত শাহের ৩৫ আসনের খোয়াব তো দলই দেখছে না। কারণ, ২০২৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপির টার্গেট ২২। তাহলে পঁয়ত্রিশের গল্প আসছে কোথা থেকে? আর যে আসনগুলি তাদের টার্গেট, সেখানে দলের অবস্থাটা কি? যেমন, শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র। এই আসন এবার বিজেপির টার্গেট। টার্গেট করা তাদের আসনগুলির পর্যবেক্ষক হয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবর্গ। শ্রীরামপুরের দায়িত্ব বর্তেছে কেন্দ্রের মন্ত্রী স্মৃতি ইরানীর কাঁধে। কিন্তু প্রাক্তন এই অভিনেত্রীর রুদ্রমূর্তি দেখে, দলের কর্মীরা বলছেন, ‘এরাই বিজেপিকে ডোবাবে!’
আরও পড়ুন: তীব্র গরমে রাজ্য জুড়ে সক্রিয় জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ, জলের সমস্যা রুখতে একাধিক পদক্ষেপ
বিজেপির শ্রীরামপুর সাংগঠনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্মৃতি ইরানী বৈঠকে বসেন ১৭ এপ্রিল। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কেন্দ্রের কত বুথে দলের ৩১ জন সক্রিয় কর্মী খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, প্রথমেই জানতে চান স্মৃতি। শ্রীরামপুর কেন্দ্রে মোট ১৪০০ বুথ। বৈঠকে উপস্থিত বিজেপির কর্মকর্তারা এই প্রশ্নে শুরুতেই একটু ব্যাকফুটে চলে যান। কারণ, তারা কবুল করেন, মাত্র ৭৮টি বুথে পাওয়া গিয়েছে। সব মিলিয়ে ৪০০ বুথে ১০ জনের মত বিজেপির সক্রিয় কর্মীর নামের তালিকা হয়েছে। বাকি বুথের অবস্থা বলার আগেই স্মৃতি সবাইকে থামিয়ে দেন। সঙ্গে দেন ধমকও। এই সময় ডোমজুড়ের এক দলীয় কর্তা বলে বসেন, ‘আসলে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা পাওয়া যাচ্ছে না বলে, মানুষ বিজেপির ওপর রেগে আগুন হয়ে আছে। আমরা যদি এই প্রকল্পের ন্যায্য প্রাপকদের নামের একটা তালিকা তৈরি করে, তাদের টাকা পাইয়ে দিতে পারি…… ।’ এই পর্যন্ত শোনার পর স্মৃতির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। তিনি বলে ওঠেন, ‘থামুন। কিছু জানেন না। কোন প্রকল্পে কী করে কাজ হয়, না জেনেই কথা বলছেন। আসলে আপনারা কোনও কাজের নন, খালি মুখে বড় বড় কথা!’ বৈঠকে উপস্থিত এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘আমাদের অনেকেরই বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু কিছু কথা বলার ছিল। কিন্তু স্মৃতি ইরানীর রুদ্রমূর্তি দেখে আর কেউ এগোতে সাহস পায়নি। সবাই বুঝে গিয়েছে, নেতা-নেত্রীদের ইয়েস ম্যান হয়ে চলতে হবে। সবাইকে বলতে হবে, বিজেপি দারুনভাবে এগােচ্ছে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, বিজেপির এ রাজ্যে ৫টি আসন জেতার ক্ষমতা আছে? প্রশ্নটা সঙ্গত নয় কি?