রবীন্দ্রনাথ (Nationalist Rabindranath) তাঁর মাতৃভূমিকে কতখানি ভালবাসতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত গান ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গানটিতে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাখীবন্ধন উৎসবের প্রবর্তন এবং ‘বিধির বাঁধন কাটতে তুমি’, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে’, ‘এবার তোর মরা গাঙে’, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’র মতো গানের মাধ্যমে সমগ্র বঙ্গদেশকে তিনি উত্তাল করে তুলেছিলেন। এর পরেই স্বদেশি ও বয়কটের যুগ। এই সময় থেকে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে সূচিত হল রবীন্দ্রনাথের বিরাট ব্যবধান। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি তিনি বিরূপ হয়ে ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে বিপ্লবীদের কালিমালিপ্ত করলেন। ছাপার অক্ষরে বিপ্লবীদের তীব্র নিন্দা করলেন। এর অনেক পরে যখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে এল অসহযোগ আন্দোলনের যুগ তখনও রবীন্দ্রনাথ সে-আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন না যদিও গান্ধীর প্রতি ব্যক্তিগতভাবে ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সময় রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় জাতীয়তার তুলনায় আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমৈত্রী আদর্শ অধিকতর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর এই গভীর আন্তর্জাতিকতাবাদকে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গেও এখানেই তাঁর বিরোধ বাধে এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্কে চিড় ধরে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যখন তিনি সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস সভাপতিরূপে নির্বাচন ও পুনর্নিবাচনকে সমর্থন করে এবং তাঁকে দেশনায়করূপে বরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে জাতীয়তা না আন্তর্জাতিকতা, কোনটি অগ্রাধিকার পেয়েছিল, দ্বিতীয়ত, তিনি কি গান্ধীর মতো বিপ্লবীদের জাতশত্রু ছিলেন? তৃতীয়ত, তিনি কি হিংসা ও সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে অহিংসার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের কথা ভাবতেন? চতুর্থত রবীন্দ্রনাথ কি রাজনীতির জগতকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করেছিলেন? ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দেননি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে কি তাঁকে স্বপ্নবিলাসী কল্পনাপ্রবণ বাস্তবচেতনা বর্জিত ভাববাদী দার্শনিক রূপে চিত্রায়িত করা উচিত?
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা উচিত যে, রবীন্দ্রনাথ (Nationalist Rabindranath) কোনওদিনই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তার অর্থ এই নয় যে তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন কারণ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পরাধীন দেশের কবি এবং পরাধীনতার জ্বালা তিনি অনুভব করতেন না বললে সত্যের ঘোর অপলাপ হবে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর নাইটহুড খেতাব বর্জন পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নারকীয় হত্যালীলার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিবাদ ছিল। সম্ভবত সেই জন্যই কাজী নজরুল রবীন্দ্রনাথের মহা প্রয়াণের পর রচিত রবীহারা কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বলদর্পীর মাথার উপরে চরণ রাখিয়া আজ রক্ষা করিবে কে এই দুর্বলের সে অহংকার।’
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় মহাবিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ স্বামী পুণ্যাত্মানন্দের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, তাঁর ‘চার অধ্যায়’, ‘ঘরে বাইরে’— উপন্যাস দুটি স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ক্ষতি করেছে। পুলিশ এই উপন্যাসগুলি কারাগারে বিপ্লবীদের মধ্যে প্রচার করত। বিপ্লবীদের মধ্যে দু-একজন বিপথগামী হতেই পারে। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগের দিকটা রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েনি। এই অভিযোগের মধ্যে কিছু পরিমাণ সত্য থাকলেও তার সবটুকুকে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ ঘরে বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সন্দীপকে লম্পটরূপে চিত্রায়িত করলেও অমূল্যর মতো নিঃস্বার্থ বিপ্লবীর চরিত্রায়ণও করেছেন। তা কেন হেমচন্দ্র ঘোষের চোখে পড়েনি? রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগ প্রসঙ্গে হেমচন্দ্রের উক্তি, রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড গ্রহণ করা উচিত হয়নি, কেবলমাত্র অবজ্ঞারই উদ্রেক করে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মতো রবীন্দ্রনিন্দুকও বলেছিলেন, ‘এই তো তোমার উপযুক্ত কাজ।’ রবীন্দ্রনাথের এত বড় স্বাজাত্যবোধের দৃষ্টান্তকে অস্বীকার করে হেমচন্দ্র ঘোষ ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য একথা সত্য যে, বিপ্লবীদের প্রতি রবীন্দ্রনাথ সবসময় সুবিচার করেননি। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী জেলাশাসক কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে দুজন আমেরিকান মহিলাকে হত্যা করেন। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা করে বলেন, ‘রাক্ষস এসে স্বদেশলক্ষ্মীর মঙ্গলঘট উলটে দিয়েছে।’ বিপ্লবীদের তিনি কাপুরুষ বলেছেন একাধিকবার।
এতৎসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত মানসিকতা অনুধাবন করতে গেলে বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সরিয়ে রেখে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।
আরও পড়ুন-খাড়্গে ও তাঁর পরিবারকে খুনের হুমকি বিজেপি প্রার্থীর
রবীন্দ্রনাথ (Nationalist Rabindranath) ছিলেন গঠনমূলক আন্দোলনের পক্ষপাতী। ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট ও ব্রটিশ বস্ত্রের বহ্ন্যুৎসবের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আত্মশক্তির উপাসক। তিনি মনে করতেন যে, দেশের মানুষ যদি কোনও কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকারের মুখ চেয়ে না থেকে নিজেরাই তা করে ফেলতে পারে তাহলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনিক যন্ত্র তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। অনেকটা রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রের মতো ব্যবস্থার কথা রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন। আরেকটি বিষয়, তাঁর চিন্তাজগৎ জুড়ে বিরাজ করত। তা হল বৃহত্তর মানবমুক্তি। রবীন্দ্রনাথের এই আন্তর্জাতিকতাকে অনেকেই আতিশয্যপূর্ণ বিবেচনা করতেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা গোপাল হালদারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তোমাদের আন্তরিক যন্ত্রণা বুঝলাম। কিন্তু দেখাে ব্যাপারটাকে ওভাবে দেখলে হবে না। আমাদের দেশেও এক অসামান্য সমস্যা বিরাট বড় প্রশ্ন। সম্ভবত সমস্ত পৃথিবীর বৃহৎ সমস্যার সঙ্গে তা জড়িত। রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্র বিভাজনের এই প্রথম পাঠটি কিছুতেই গ্রহণ করতে চইছেন না যে সর্বপ্রকার আদান-প্রদান, আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ শুধু সমানে সমানে চলে, পৃথিবীর কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রই পরাধীন দেশের অন্যকে আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। এইজন্যই রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধের বিরোধিতা করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘শিক্ষার বিরোধ’।
রবীন্দ্রনাথ শেষ দিকে ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে দেশনায়ক নির্বাচন তার প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ নিজের অজন্মলালিত স্বপ্ন ও আদর্শের প্রতিফলন ও অনুরণন দেখেছিলেন বলেই সুভাষচন্দ্রের পুনর্নিবাচনকে সমর্থন করেছিলেন। এই পর্যায়ের রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি বাস্তববাদী ও সুভাষচন্দ্রর সঙ্গে এক পথের পথিক।