কার্তিক ঘোষ, বাঁকুড়া : জঙ্গলমহলের রাইপুর বাজারের কাছে চান্দুডাঙা গ্রামে মহামায়া মন্দিরে পূজিত হন দেবীর কোকামুখো প্রস্তরমূর্তি। এটি দুর্গার অন্য একটি রূপ এবং রাইপুরবাসীর কাছে ইনি জাগ্রত দেবী হিসাবে খ্যাত। চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক রাজা দুর্জন সিংহের পারিবারিক দেবী হলেও এখন তিনি সর্বজনীন। কথিত, আজ থেকে প্রায় ৮৫০-৯০০ বছর আগে বিষ্ণুপুরের নফর নামে এক শাঁখারি আলমসায়ের পুকুরের পাড় ধরে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিলেন। সেসময় পুকুরঘাটে বসে থাকা একজন সুন্দরী মেয়ে তাঁর কাছে শাঁখা পরতে চান। শাঁখারি বলেন, তুই বাচ্চা মেয়ে, পয়সা কোথায় পাবি? তখন মেয়েটি বলে, দেওঘোরাদের কালাচাঁদ সন্ন্যাসীকে গিয়ে বলবে তোমার মেয়ে শাঁখা পরেছে। কুলঙ্গির ভাঁড়ে পয়সা আছে, তার থেকে পয়সা দিতে বলবে। শাঁখারি শাঁখা পরিয়ে শাঁখারি কালাচাঁদ সন্ন্যাসীকে বলেন, তোমার মেয়ে পুকুরঘাটে শাঁখা পরেছে আর বলেছে কুলুঙ্গির ভাঁড়ে দেড় ছেদাম পয়সা আছে, সেটা দিতে। সন্ন্যাসী বলেন, আমার মেয়ে কোথায়! আমি বিয়েই করিনি! শাঁখারি সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরঘাটে গিয়ে দেখেন কেউ নেই। তখন সন্ন্যাসী বলেন, পয়সা আমি দিয়ে দেব, কিন্তু কে শাঁখা পরেছিস, দেখা দে। তখন দুজনের চোখে পড়ে পুকুরের জলের উপর তিন জোড়া হাত, যার ছয় হাতে রয়েছে ছটি শাঁখা। প্রণাম করে সন্ন্যাসী ও শাঁখারি বাড়িতে ফিরে এসে দেখেন ভাঁড়ের মধ্যে দেড় ছেদাম পয়সা রাখা। শাঁখারি মাকে প্রণাম করে পয়সা নিতে অস্বীকার করেন এবং প্রতি বছর মায়ের পুজোয় ছটি শাঁখা দেওয়ার অঙ্গীকার করে ফিরে যান। সেই থেকে ওই শাঁখারির বংশধররা প্রতি বছর মা মহামায়াকে পুজোয় ছটি শাঁখা (প্রসঙ্গত, রাইপুরের মা মহামায়ার ছটি হাত), পাঁচ ষোলোআনা ও একটি আলতাপেড়ে কাপড় দিয়ে যান।
আরও পড়ুন-বাংলার ত্রিনয়ন, এখন পুজোকে ভয় পাচ্ছে বিজেপি!
গবেষকদের মতে, এটি কোকামুখো দ্রাবিড়ীয় দুর্গামূর্তি, ১০২৪-১০২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্র চোল এই এলাকা আক্রমণের সময় মূর্তিটি সঙ্গে এনেছিলেন। সে দিক থেকে এই মূর্তির বয়স হাজার বছর হতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। শিখর বংশের সময়কালে আলমসায়ের, শিখরসায়ের-সহ সাতটি পুষ্করিণী খনন করা হয়। মুঘল আমলে রাজপুতানা থেকে এসে চৌহান বংশীয় রাজা শিখর রাইপুরে বসতি স্থাপন করেন। শিখরদের শেষ রাজার রাজত্বকালে বর্গীরা আক্রমণ করে ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। দুর্জন সিংহের বংশের বর্তমান কর্ণধার গোপীনাথ সিংহ দেও জানান, ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের পরিবারের সদস্যরা এখানে রাজত্ব শুরু করেন।
আরও পড়ুন-বাংলার ঢাকিদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান
উল্লেখ্য, রাজা দুর্জন সিংহের রাজবাড়ি রাইপুর বাজার থেকে ৫ কিমি দূরে নতুনগড়ে। প্রাচীন রীতি মেনে কৃষ্ণানবমীর দিন থেকে মা মহামায়ার পুজোর সূচনা হয় রাজবাড়িতে। প্রতি বছর মহাষষ্ঠীর বিকেলে রাজলক্ষ্মীকে নিয়ে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, কাঁসরঘণ্টায় মুখরিত শোভাযাত্রা সহকারে মহামায়ার মন্দিরে আনা হয়। দেবী দুর্গার আগমন এবং প্রত্যাগমন হয় যে যানে, অনুরূপ ভেলা বা জীবজন্তু ব্যবহার করা হয় প্রতি বছর। এলাকার মহিলারা পঞ্চপ্রদীপ হাতে দেবীর আরতি করতে থাকেন ৫ কিমি রাস্তার দু’পাশে। চারদিন লক্ষাধিক মানুষ আসেন, এমনকি প্রতিবেশী রাজ্য থেকেও। দশমীর দিনে শোভাযাত্রা সহকারে দেবী রাজ অন্তঃপুরে ফিরে যান।