২০২১ এর পশ্চিমবঙ্গের পর ২০২৩ এর কর্নাটক।
ফের প্রমাণ হল—গণতন্ত্রে কোনও দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা, সাম্প্রদায়িক বিষ, দেদার টাকা আর এজেন্সি শেষকথা বলে না, বলেন সাধারণ ভোটাররাই। হাজার হাজার রোড শো করলেও মানুষের অসন্তোষ ও প্রত্যাখ্যানকে জাদুবলে ঢেকে দেওয়ার ক্ষমতা নেই ছোট-বড় কোনও নেতার।
নরেন্দ্র মোদি বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে, বিরোধীদের দরজায় এজেন্সি পাঠিয়েও দেশটাকে কিছুতেই কব্জা করতে পারছেন না। হিমাচল গিয়েছে, কর্নাটকও (Karnataka Election result) হাতছাড়া হল। মধ্যপ্রদেশ সহ একাধিক রাজ্যে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের হিসেবও মানুষ ঠিক সময় চুকিয়ে দেবে। রাজস্থানে বিদ্রোহ করে বসে আছেন স্বয়ং বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী বসুন্ধরা রাজে। উত্তরপ্রদেশে ঝুঁকির গন্ধ পেলেই আইনের নজর উপেক্ষা করে এনকাউন্টারে খতম করে দিচ্ছেন মহান যোগী। সবই উতরে যাচ্ছে দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও গেরুয়া শিবিরের বিপদ কিন্তু ক্রমেই ঘনাচ্ছে।
প্রায় পাঁচদশক আগের কথা। অসমের নেতা দেবকান্ত বড়ুয়া স্লোগান তুলেছিলেন, ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া!’ মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন তামাম বিরোধী শক্তির। শাসক শিবিরের সেই স্লোগান হালে পানি পায়নি। ভরাডুবি হয়েছিল শাসক পক্ষের। জয়কেতন উড়িয়েছিল বিরোধী শক্তি।
এতদিন পর শততম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে মোদিজি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মনের কথা, ‘মোদি ইজ ইন্ডিয়া’। কর্নাটকের (Karnataka election result) ফল দেখাল, এবারও সংবিধানে আস্থা জ্ঞাপক আমজনতাই জয়ী। গণতন্ত্র কারও পকেটে থাকা সস্তা পণ্য নয়। ঠিক সময় পাশা উল্টে দেয় জনগণ। তাই, দাক্ষিণাত্য থেকে মুছে গেল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা, সকাল বিকেল জনসভা, হরেক কিসিমের প্রকল্প ঘোষণা কোনও কাজেই এল না। মুখ থুবড়ে পড়ল সব।
অর্থনীতিতে পড়ানো হয় ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’। একই সম্পদ বারবার ব্যবহার করলে তার উৎপাদনশীলতা কমে যায়। একইভাবে বারবার একই অস্ত্র ব্যবহার করলে সেটা ভোঁতা হতে বাধ্য। গত এক দশক ধরে কী বিধানসভা, আর কী লোকসভা, বিজেপির প্রচারের মুখ সেই একজনই। ফলত অতি ব্যবহারের অনিবার্য পরিণামে ‘মোদি ম্যাজিক’ আজ ফিকে। সব রসদ ও ক্ষমতা লাগিয়েও তাই দাক্ষিণাত্য বিজয় আটকে গেল বিজেপির। প্রমাণ হয়ে গেল, ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্ষমতা কোনও ব্যক্তি ও তাঁর অনুচরবর্গের হাতে বেশিদিন আটকে থাকে না। বারবার একই অস্ত্র ব্যবহার করলে তার ধার কমতে বাধ্য। কয়েকমাস আগে হিমাচলে তা প্রমাণিত হয়েছিল। এবার কর্নাটকও তা প্রমাণ করল। আর পশ্চিমবঙ্গে মোদি ম্যাজিক কোনও কালে ছিল না, আজও নেই। বঙ্গ কেবলই মমতাময়। অভি-যাত্রার প্লাবনে সেখানে নব জোয়ার, জন জোয়ার।
উত্তর ভারতে আগামী বছরের ভোটে একাধিক রাজ্যে দলের আসন কমতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই দক্ষিণে ঘন ঘন প্রচারে দেখা যাচ্ছিল মোদিজিকে। আসন্ন চব্বিশের মেগা ফাইনালে কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও তেলেঙ্গানাকে পাখির চোখ করেছিলেন তিনি। কারণ দক্ষিণে ১৩০টি লোকসভা আসন রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই বারবার বার্তা দিতে চাইছেন সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ভোটারদের। কিন্তু কর্নাটক হাতছাড়া হতেই তাঁর সেই প্রয়াসও মাঠে মারা গেল। দক্ষিণ থেকে গেরুয়া পতাকার এই পিছু হটার অর্থ বিজেপি আবার হিন্দি বলয়ের দল হিসেবেই ছোট্ট গণ্ডিতে গুটিয়ে গেল। হিন্দি হিন্দুত্বের বেড়ায় আটকে আছে এই জঞ্জাল পার্টি। সর্বভারতীয় অস্তিত্ব এখন তাদের কাছে স্রেফ কথার কথা।
পূর্বে বাংলা, বিহার, ওড়িশায় অনেক চেষ্টা করেও বিজেপি হালে পানি পায়নি। মণিপুরে বিজেপি ক্ষমতায়, কিন্তু রাজ্যটা জ্বলছে। মানুষ দেখছে ডবল ইঞ্জিনের ধাপ্পা, ট্রাবল ইঞ্জিনের উৎপাত। পশ্চিমে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে একটা আশ্চর্য রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গেরুয়া দলেরই সৌজন্যে।
এই আবহেই কর্নাটকে (Karnataka election result) ক্ষমতা ধরে রাখতে গেরুয়া পার্টির ৯ হাজারের উপর জনসভা করেছে, প্রায় দেড় হাজার রোড শো করেছে। তার মধ্যে অন্তত ৫০টি জনসভা ও রোড শোতে হাজির আধুনিক বিজেপির প্রাণভোমরা ১১২ ইঞ্চি ছাতির সম্রাট নরেন্দ্র মোদি। আরও অন্তত এক ডজন সভায় গৌরবময় উপস্থিতি অমিত শাহের। শেষে তাঁদের জুটেছে লবডঙ্কা। ঠিক যেমন জুটেছিল বাংলায়। প্রাণপণ নোংরামি করা সত্ত্বেও।
জনসভায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী ছুঁড়ে দিচ্ছেন জয় বজরংবলী স্লোগান। বজরংবলীর মাহাত্ম্য ভক্ত হিন্দুমাত্রই জানে। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন ভোটের ৭২ ঘণ্টা আগেও ওই স্লোগানেই ভরসা রাখেন তখন স্পষ্ট বার্তা যায়, এই ধর্ম ভক্তি, শ্রদ্ধা, সৌজন্য, সহাবস্থান, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতার কথা বলে না। উল্টে প্রতিনিয়ত মেরুকরণের বীজ বপন করে। এর পাশাপাশি একটা নিছক সিনেমাকে নির্বাচনী প্রচারের অস্ত্র করেছে বিজেপি। একবছর আগে দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখিয়ে হিন্দু ভোটকে সুসংহত করার চেষ্টা হয়েছিল। তারপরও হিমাচল গেরুয়া দলের হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এবার দ্য কেরল স্টোরি। দুঃখটা এখানেই। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে একমুখে বিকাশ ও উন্নয়নের কথা বলব, আবার সাম্প্রদায়িকতার তাসও খেলব, দুটো একসঙ্গে হয় না। হয় না বলেই দক্ষিণের একমাত্র রাজ্য থেকেও মুছে যেতে বসেছে বিজেপি।
সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়েও কর্নাটকে যখন নরেন্দ্র মোদি নামক মহীরুহ মুখ থুবড়ে পড়েছেন, তখন উত্তরপ্রদেশে শুধুই যোগী হাওয়া। উত্তরপ্রদেশের পুর নির্বাচনে জয়ী যোগী আদিত্যনাথ। বছর দুয়েক ধরে গেরুয়া পার্টির অন্দর থেকেই ‘মোদি হটাও যোগী লাও’ স্লোগান চোরাগোপ্তা উঠছে। এবার সেটাই জোরালো হবে।
অমৃতকালেই কি তবে শেষ হয়ে যাবে মোদির যাবতীয় কারিকুরি? কর্নাটক এই প্রশ্নটাই তুলে দিয়ে গেল।
আরও পড়ুন: অভিষেককে অনুরোধ, আলো জ্বলল হাইমাস্টে