আজ মহাষষ্ঠী। দেবীর বোধন। বেলগাছে পূজিতা হবেন মা দুর্গা। কেন এভাবে বিল্ববৃক্ষে বোধনের বিধান? শাস্ত্র-পুরাণ আর সমাজ-ইতিহাস ঘেঁটে তত্ত্বতালাশে
দেবাশিস পাঠক
মহাষষ্ঠী। দুর্গাপুজোর শুরু। দিনের বেলায় কল্পারম্ভ, সন্ধেতে বোধন। ‘বোধন’ মানে উদ্বোধন। পুজো শুরুর আগে দেবীর ঘুম ভাঙানো। আর কল্পারম্ভ মানে মহাদেবীর পূজার জন্য সংকল্পের সূত্রপাত।
এই মহালগ্নে দেবীমূর্তি নয়, বেলগাছ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিল্ববৃক্ষের সঙ্গে দেবীর অভেদ কল্পনা করে পুরোহিত পুজো শুরু করেন। প্রার্থনা মন্ত্রে বলেন, মেরু, মন্দার, কৈলাস ও হিমালয় পর্বতের শৃঙ্গে উৎপন্ন শ্রীফলবৃক্ষ, তুমি সর্বদাই দেবী অম্বিকার প্রিয় এবং শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবীর আবাস। আমি তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, দুর্গাস্বরূপে পূজিত হওয়ার জন্য তুমি এস। নেতব্যো সি ময়াগচ্ছ পূজ্যো দুর্গাস্বরূপতঃ।
এখানে দুটো প্রশ্ন।
এত কিছু থাকতে মূর্তি ছেড়ে গাছে দেবীর পুজো কেন?
আর, এত গাছ থাকতে বেলগাছকেই বা কেন এত গুরুত্বপ্রদান?
প্রথমটির উত্তর নিহিত রয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিতে। মানুষ কল্পনার অর্ঘ্য দিয়ে অন্তরের বেদীমূলে যুগ যুগান্তর ধরে দেবী দুর্গার ধ্যানমূর্তির পুজো করেছে। সেই ধ্যানমূর্তি আদিতে ঠাঁই পেয়েছিল গাছে। আর এ ঘটনা যে কেবল ভারতবর্ষে ঘটেছিল, তা নয়। বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় জাতি বৃক্ষপূজা করত।
আসলে প্রাচীন যুগে মানুষ ভাবত, প্রতিটি গাছে, গাছপালায় ভর্তি বনে, ঝোপে শক্তিমান দেবতা কিংবা অপদেবতারা বাস করেন। বৃক্ষের বা বৃক্ষসমাকীর্ণ অরণ্যের পূজার অর্থই হল শক্তিশালী দেবতা কিংবা অপদেবতার পূজা করা। তাঁদের অনুগ্রহ ও সাহায্য প্রার্থনা করা। কেন গাছেই দেবশক্তি বা অপদেবতার অনুভব, তা ব্যাখ্যাত হয়েছে জেমস ফ্রেজারের লেখায়। প্রথমত, গাছের কল্যাণেই বৃষ্টি নামে। সকালের সূর্য ওঠে গাছের মাথায়। পাখি আর সরীসৃপ বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে, বংশবিস্তার করে গাছের ডালে ও কোটরে। সুতরাং, বৃক্ষ চৈতন্য বা Tree spirit-এর পূজন তাদের কাছে স্বাভাবিক ছিল। দ্বিতীয়ত, গাছেদের বৃদ্ধি, বংশবিস্তার, এসব কিছুতেই কোথাও যেন একটা মনুষ্যসুলভ প্রকৃতি সংগুপ্ত। ফ্রেজারের ভাষায়, ওইসব বৈশিষ্ট্যের কল্যাণে বৃক্ষদেবতাগণ ‘anthropomorphic being’ বলে কল্পিত হতেন। বৃক্ষে নরত্ব আরোপিত হত পূজার ছলে।
আর বেলগাছ কেন? প্রাচীনকালে ভাবা হত বিল্ববৃক্ষ হল সূর্যের আসন। গাছের মাথা আকাশ ছুঁত। গাছগুলো বেশ ছড়ানো। সূর্য যখন উঠত তখন প্রাচীন মানুষ সেই জ্যোতির্বলয়কে দেখত বিল্ববৃক্ষের শীর্ষে। যজুর্বেদে তাই স্পষ্ট সূর্যদেবকে বলা হয়েছে, “তোমার বাবা-মা তোমাকে বৃক্ষশিখরে স্থাপন করেছে।” এ শুধু ভারতের ঋষির কথা নয়। আসিরিয়া, ব্যাবিলন, মিশর, সর্বত্র মানুষ মনে করত, বিশ্বাস করত, দিগন্ত থেকে সূর্য ওঠা আর দিকচক্রবালে সূর্যের অস্ত যাওয়ার অর্থ পৃথিবীর গর্ভ সূর্যের আধার ও আশ্রয়স্থল, মাতৃগর্ভ ও মায়ের কোল। তাই পৃথিবী হল মা। আকাশ তার বাবা। বিল্ববৃক্ষ জ্যোতির্বৃক্ষ। আর বেলফল হল সূর্যের প্রতীক। বিল্বং জ্যোতিরিতি আচক্ষতে। সূর্যের অনুকল্প যজ্ঞের আগুন। সেজন্য হোমের সময় পবিত্র বেলগাছের পাতাকে ঘিয়ে চুবিয়ে হোমাগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। হোমের আগুন জ্বালাতে ব্যবহার করা হয় বেলকাঠ।
বিল্ববৃক্ষের পাতা, ডাল, ফল, সবকিছুই পবিত্র যজ্ঞকর্মে ব্যবহারযোগ্য। তার ওপর বেলগাছ হল সূর্যের বসার আসনটি, ব্রাক্ষণসাহিত্যের ভাষায় ‘আদিত্যযূপ’। স্বামী শংকরানন্দ ‘Rigvedic Culture of the Prehistoric Indus’ গ্রন্থে লিখলেন, ঊষালগ্নে সূর্যকে অভিবাদন জনিয়ে তাকে বসার আসন পেতে দেয় বিল্ববৃক্ষ। রচনা করে যূপ। ‘যূপ’-এর অর্থ ‘যা যোগ করে’। আসন রূপে যূপ সূর্যকে নিজের সঙ্গে অন্বিত করে নেয়। ‘As a seat, the Yupa joins the sun to it.’
এই সূর্যসম্বন্ধই বিল্ববৃক্ষকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। ‘যোগিনীতন্ত্র’ বলছে শ্রীশৈলপর্বতে জাত বেলগাছ ‘ব্রহ্মবিষ্ণুশিবাত্মক’ এবং মহালক্ষ্মী স্বরূপিনী। তার কাছে যা প্রার্থনা করা হয় সে তা-ই দেয়, সে হল ‘কল্পবৃক্ষসমো’। সে মহাদেবের প্রিয়, মহাদেবী উমার প্রিয়, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণেরও প্রিয়। মহাদেব প্রিয়করো বাসুদেব প্রিয়ঃ সদা। উমাপ্রীতি করো বৃক্ষঃ বিল্ববৃক্ষ নমোহস্তুতে।।
যোগী বলেন, এই বিল্ববৃক্ষ আসলে মানুষের দেহস্থিত সুষুম্নাকাণ্ডের প্রতীক। এই সুষুম্নাকাণ্ডে ও মস্তিষ্কে সূক্ষ্মভাবে অবস্থান করে তন্ত্রে উল্লিথিত ১৫টা পদ্ম বা চক্র। মূলাধারে জীবাত্মারূপিনী কুলকুণ্ডলিনী সুপ্ত থাকে। আর সহস্রার বা ব্রহ্মাচক্রে পরমশিবের অধিষ্ঠান। দেহরূপ বিল্ববৃক্ষই মহাদেবীর আরাধনার প্রকৃষ্ট মন্দির। মূলাধারের কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে যোগসাধনার দ্বারা চক্র পরম্পরায় উদ্বুদ্ধ করাই হল মহাষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষের মূলে দেবীর বোধন।
আর একালের দার্শনিক অনুভব করেন, বিল্ববৃক্ষে দেবীপূজার মধ্য দিয়ে আদিম মানুষের বৃক্ষপূজার ধারাটি বয়ে চলে একথা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে এই বিল্ববৃক্ষ পূজার মধ্যে সেই ‘সর্বংখল্বিদং ব্রহ্ম’, সর্বত্রই ব্রহ্মের অধিষ্ঠান, এ তত্ত্বেরও যথাযথ প্রকাশ।
লোকায়ত অনুভবে, এরাজ্যে এখন দেবীশক্তি উদ্বোধনের নিত্য আয়োজন। নিরন্তর বোধনের রাষ্ট্রীক বন্দোবস্ত। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী থেকে স্বাবলম্বন, রাজ্য সরকারের প্রতিটি প্রকল্পে নারীশক্তির প্রাত্যহিক ক্ষমতায়নের স্বীকৃত আয়োজন। মাতৃশক্তির ক্ষমতায়নে তাই ব্রঙ্গভূমে দেবীর নিত্য বোধন। বিল্ববৃক্ষের প্রতীকী পূজানুষ্ঠান এখানে জনমুখী প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণে বাস্তবোচিত মাতৃবন্দনা। এই মাটিতে তাই আজকের সন্ধ্যায় অযুত কণ্ঠে আবেগ দীপ্রভাবে একটি মন্ত্রেরই অনিবার্য অনুভব—
‘ওঁ অহমাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামিবৈ।’
আমিও আশ্বিনের ষষ্ঠীতিথিতে সন্ধ্যাকালে তোমার বোধন করছি।