নবনীতা মণ্ডল, নয়াদিল্লি : দিল্লির সবথেকে প্রাচীন দুর্গাপুজো এটি। একদা যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ইন্দিরা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বরা। এই পুজো কমিটিরই ক্লাব, ‘বেঙ্গলি ক্লাবে’ এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। ‘দিল্লি দুর্গাপুজো সমিতি’র সেই পুজো যা মূলত কাশ্মীরি গেটের পুজো নামেই বিখ্যাত, তা এবছর ১১২ তম বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। শুধু প্রাচীনত্বই নয়, সবথেকে বড় দুর্গা প্রতিমা গড়ার কৃতিত্বও এই পুজো কমিটির। তবে লাগাতার দুই বছর করোনা মহামারীর ধাক্কায় এবারেও মূর্তির বদলে ঘটপুজোতেই, নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে। আর তাই মন খারাপ কাশ্মীরি গেটের প্রাচীন এই দুর্গাপুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের।
আরও পড়ুন : বাংলা থেকে প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষায়
এই পুজো যখন শুরু হয়েছিল ১৯১০ সালে, তখন দেশের শাসনভার ছিল ব্রিটিশ সরকারের হাতে। কিন্তু উৎসবমুখর বাঙালিকে দমাতে পারেনি ব্রিটিশের লাল চোখ। তাই বাংলার বাইরে ব্রিটিশদের দ্বারা সদ্য স্থানান্তরিত হয়ে রাজধানীর তকমা পাওয়া দিল্লির বুকে সদর্পে বাঙালিবাবুদের হাত ধরে অনুষ্ঠিত হল দিল্লির প্রাচীন দুর্গাপুজো,দিল্লির রোশনপুরা কালীবাড়িতে।
১৯১০ সালে প্রবাসী বাঙালিদের হাতে এই পুজোর গোড়াপত্তন হলেও, সেই সময়কার রেলের এক বাঙালি ডাক্তার হেমচন্দ্র সেনের অবদানের কথা কোনওদিন ভুলবে ননা এখানকার উদ্যোক্তারা। ১৯১০ থেকে ২০২১ লম্বা এই যাত্রাপথে একদিকে যেমন যমুনা দিয়ে বয়ে গেছে বিস্তর জল, অন্যদিকে রাজধানীর রাজনীতিতেও বারবার পটভূমি বদল হয়েছে। ঠিক তেমনই রোশনপুরা কালীবাড়ি থেকে যে পুজোর সূচনা হয়েছিল, কয়েক প্রজন্ম পরে আজ তার ঠিকানা সিভিল লাইন্সের শ্যামনাথ মার্গের বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল ময়দান। ১৯৬৮ সালে এই পুজো স্থানান্তরিত হয় সিভিল লাইন্সে শ্যামনাথ মার্গের বেঙ্গলি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল ময়দানে। তারপর থেকে সেখানেই পুজো কমিটির নাম বদলে ‘দিল্লি দুর্গাপূজা চ্যারিটেবল অ্যান্ড কালচারাল সমিত’র নামে হচ্ছে পুজো। পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক রবীন বসু জানালেন, শুধু প্রাচীনত্বের দিক দিয়েই নয়, পুজোর নিয়ম-কানুনের দিক দিয়েও দিল্লির বাকি সমস্ত পুজোর থেকে আলাদা এই পুজো। কোনওরকম পরিবর্তন ছাড়াই পুজোর সূচনাকাল থেকে চলে আসা প্রত্যেকটা রীতি ও নিয়মকে আজও নিষ্ঠাভরে পালন করা হয় এখানে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক পরিবর্তন হলেও, পুজোর এই ক’টা দিন এখানকার বাঙালিরা সাবেকিয়ানা ছেড়ে এক চুলও নরেন না। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া আজও প্যান্ডেলে বাজানো হয় না কোনও হিন্দি গান। প্রাচীন নিয়ম মেনে এখনও প্রতিমা বিসর্জন হয় গরুর টানা গাড়িতে করে। বিশাল বড় মণ্ডপ নয়, হাজার হাজার মানুষের সমাগমই কাম্য এখানকার পুজো উদ্যোক্তাদের। দিল্লি ও আশপাশের যত প্রবাসী বাঙালি আছে, তারা যেন এই ক’টা দিন মন খুলে আনন্দ করতে পারে তাই ৮,০০০ স্কোয়ার ফিটের এই পুজো প্রাঙ্গণে সবার জন্য বসার সুবন্দোবস্তও থাকে। যদিও গত বছরের মতো এবছরও করোনা মহামারীর ধাক্কায় কাটছাঁট হয়েছে সেই নিয়মেও। এমনকী প্রত্যেক বছর এখানে চার হাজার লোককে পাত পেড়ে খাওয়ানো হত, বন্ধ সেটাও। অনুমতি নেই দর্শনার্থীরও। মাত্র ১০ দিন আগে সরকারি অনুমতি পেলেও, পুলিশি ছাড়পত্র মিলেছে মাত্র তিনদিন আগে। তাই অন্যান্য সব আয়োজন সেরে সম্ভব হয়নি মূর্তিপুজোর। প্রাচীনত্বের হাত ধরে দিল্লির এই পুজো তাই আরও একবার ফিরে গেছে অতীতে। মূর্তির বদলে হচ্ছে ঘটপুজো।