যে জাতির ইতিহাস মুছে ফেলা হয়, সে জাতি আপনা-আপনি অস্তিত্বহীন হয়ে যায়— এই কথাটির বাস্তবতা খুঁজতে গেলে খুব বেশি দূরদর্শিতার দরকার নেই। তথ্য-প্রযুক্তির মহাবিপ্লবের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা প্রিন্ট মিডিয়া-ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তাঁরা বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা অবশ্যই খুঁজে পাবেন। সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ইতিহাসচর্চায় (History) সংগঠিতভাবে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক অবদানকে মুছে ফেলার কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য ভারতের মুসলমান সমাজকে ইতিহাস-ঐতিহ্য বিহীন করে তোলা।
এই কর্মসূচিকে শুধু ‘ইতিহাসের গেরুয়াকরণ’ বলাটা ঠিক হবে না। বরং এটাকে একটি ধর্ম এবং একটি সম্প্রদায়ের ‘বংশ নির্মূলকরণ’-এর ফ্যাসিবাদী মেগা প্রকল্প বলা যেতে পারে।
তাই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের (History) পাঠ্যসূচিতে মুসলমান-চিহ্ন মোছার কাজ পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সম্প্রতি সিবিএসই পাঠ্যপুস্তকগুলো থেকে আফ্রিকা-এশিয়া অঞ্চলগুলোতে ইসলামি দেশগুলোর বিস্তার, প্রতিষ্ঠা ও টিকে থাকা সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভারতে মোগল রাজত্বকালের অধ্যায়গুলোও বাদ দেওয়া হয়েছে। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে উর্দু ভাষার বিখ্যাত বিপ্লবী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতাগুলি। এই পরিবর্তন কেবল ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর (এনসিইআরটি) প্রস্তাব মেনে সিবিএসই-র পাঠ্যপুস্তকগুলোতে পরিবর্তন করা হয়েছে, তা নয়, বরং প্রাদেশিক বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির শিক্ষাবোর্ডগুলিও পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন করেছে। মহারাষ্ট্রের স্টেট এডুকেশন বোর্ড পাঠ্যসূচি থেকে মোগল যুগকে বাদ দিয়েছে। মহারাষ্ট্রের ইতিহাসের সব পাঠ্যপুস্তক থেকে তাজমহল, কুতুবমিনার ও লালকেল্লার আলোচনা একেবারে গায়েব হয়ে গিয়েছে।
শুধু ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকেই নয়, উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকার একাধারে ফৈজাবাদ জেলার নাম অযোধ্যা করেছেন। এলাহাবাদের নাম রেখেছেন প্রয়াগরাজ। মোগলসরাই রেলওয়ে স্টেশনের নাম বদলে রাখা হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন। আলিগড়ের নাম বদলে হরিগড় করার প্রস্তুতি চলছে। যাতে যেভাবে আকবর এলাহাবাদীকে আকবর প্রয়াগরাজী করে দেওয়া হয়েছে, ওইভাবে যেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে হরিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়া যায়। সম্প্রতি দক্ষিণ দিল্লির মুহাম্মদপুর নামের একটি গ্রামের নাম পরিবর্তন করে মধুপুর রাখা হয়েছে। এটাকে বিজেপি বিশাল সাফল্য মনে করছে। এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তারা দিল্লির কাছে আরও ৪০টি গ্রামের নাম পরিবর্তন করার দাবি করেছে। এমনকী এই গ্রামগুলির তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে।
মুসলিম নামগুলো পরিবর্তনের এ কর্মসূচি গ্রহণের কারণ কী— এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুব দুরূহ নয়। ভারতে মুসলমানরা প্রায় আটশো বছর শাসন করেছে এবং মোগলদের শাসন ছিল তিনশো বছরের ইতিহাস। মানুষের স্মৃতি থেকে এ-কথা একদম মুছে ফেলার চেষ্টা যে, মুসলিম শাসকরা ভারতকে সমৃদ্ধিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্থাপত্য-শিল্পকলার নির্মাণ কলাকৌশল উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছেছিল। মোগল ইতিহাস মুছে ফেলার পশ্চাতে তাগিদ হল— এটা প্রমাণ করা যে, ভারতের উন্নয়নে মুসলমানদের কোনও অবদান নেই এবং ভারতের সভ্যতার বিকাশে না মোগল বাদশাহদের কোনও অবদান আছে, না আছে মুসলমানদের।
পাঠ্যপুস্তক থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম মুছে ফেলার কর্মসূচি তো অনেক আগেই শুরু হয়েছে। তাই আজ ভারতীয় মুসলিম সমাজের নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদের এটা জানা নেই যে, মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে এই জন্য রেঙ্গুনে বন্দি করা হয়েছিল যে, তিনি ছিলেন ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষিত নেতা। তাঁকে শুধু বন্দিই করা হয়নি, তাঁর দুই পুত্রের মাথা কেটে ট্রেতে সাজিয়ে তাঁর সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। সত্য এটাই যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি ও ইতিহাসের (History) একটা বড় অংশ মুসলমানদের রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে লেখা ৯৫ হাজার ৩০০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামের মধ্যে ৬২ হাজার ৯৪৫ জন হচ্ছেন মুসলমান। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীনতার বৃক্ষ রোপণকারী’ টিপু সুলতানের নাম কর্ণাটক রাজ্যের পাঠ্যপুস্তক মুছে ফেলারও প্রস্তাব উঠেছে। ইতিহাসের পাতা থেকে আশফাকুল্লাহ, আমির হামজা, মওলানা মাহমুদুল হাসান, মওলানা কেফায়াতুল্লাহ, মওলানা বরকতুল্লাহ ভুপালি প্রমুখ বিপ্লবী শহিদের নাম গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এমনকী মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা মোহাম্মদ আলি, মোহাম্মদ সৌকত আলি ও মওলানা হজরত মোহানিকে পর্যন্ত ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে।
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে বলা যায়, আগামীতে তো এ নামগুলো মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাবে। এখন যাদের একটি উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে, তাদেরই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে। আর যাদের কোনও ইতিহাস নেই, যেমন বিজেপি আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার, যারা স্বাধীনতার যুদ্ধে শামিল ছিল না তাদের ইতিহাসে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এমনকী সিনেমার নামে ‘কাশ্মীর ফাইলস’, ‘কেরালা স্টোরি’ ইত্যাদির ‘ক্রাফটেড’ প্রযোজনা কৌশলে বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অন্য ধর্মীয় নাগরিকদের কাছে ঘৃণ্য করে তোলা হচ্ছে। হক কথা— ভারতের মতো বহুত্ববাদী বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে এই ঘৃণার চাষ কিংবা ইতিহাসের বিকৃতি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কাঠামোর উপর বড় আঘাত। অথচ দেওয়ালের লিখন আজ স্পষ্ট। তাই প্রশ্ন জাগছে— ইতিহাস (History) বিকৃতির পথ ধরে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকে মুছে ফেলার মাধ্যমে দেশের বহুত্ববাদী আত্মার পবিত্র গ্রন্থ সংবিধানটিকেই পাল্টে দেবার বৈধতা খোঁজার মরিয়া চেষ্টা নয়তো?
আরও পড়ুন- বাম-কংগ্রেস জোটকে প্রত্যাখান মানুষের, সংগ্রামপুরের সভায় শশী পাঁজা