সেদিন সন্ধ্যাবেলায় কী হবে কেউ জানতেন না। করমণ্ডল এক্সপ্রেস একটি নামডাকওয়ালা ট্রেন। কিন্তু হঠাৎ নেমে এল কালসন্ধ্যা। সবার অজান্তে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেল বগিগুলো। করমণ্ডলের ইঞ্জিন উঠে গেল মালগাড়ির মাথায়। তার সঙ্গে আক্রান্ত হল আরও একটি ট্রেন। এতবড় দুর্ঘটনা বহু দশক ভারতবাসী দেখেনি। কত মানুষ মারা গিয়েছেন কেউ জানে না। রেল কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত মৃতের সংখ্যা কমিয়ে যাচ্ছে। এমন বীভৎস অবস্থার মুখোমুখি বহুকাল আমরা হইনি (Balasore Train accident)।
এবার এমন কেন হল সে-ব্যাপারে দু’একটা তথ্য দিই। আমরা বলি রেল হল ভারতবাসীর জীবনরেখা। লাইফলাইন। কোটি মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন। রেলের প্রধান দায়িত্ব এই কোটি কোটি মানুষের জীবন সুরক্ষা করা। অতীতের একটু কথা বলি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় রেল স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি সেই কমিটির সদস্য ছিলাম। যদি বর্তমান রেলমন্ত্রক সেই সময়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট দেখার সাহস পান তাহলে দেখবেন সেই রিপোর্টে সব চাইতে বেশি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে। নিচে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমাদের সকলের সই। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী ছিলেন। তখনও আমি রাজ্যসভার সাংসদ। তিনি তাঁর বাজেট ভাষণে বারবার নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়েছেন ও অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করেছেন।
বর্তমান কেন্দ্রীয় বিজেপির সরকার যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয় সম্পর্কে একেবারে উদাসীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অ্যান্টি ডিভাইস কলিশন লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ২০০৯-’১০ সালে। এখনও তা হয়নি। গত বাজেটে ১ লক্ষ কোটি টাকা ধার্য হয়েছিল রেল সুরক্ষার জন্য। বলা হয়েছিল ৬৮ হাজার কিমি রেলপথ সুরক্ষা কবচের মধ্যে আনা হবে। এখন পর্যন্ত ২ হাজার কিমিতে সুরক্ষা কবচ দেওয়া হয়নি। শতশত মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের বুঝতে হচ্ছে আমরা কোথায় আছি!
‘ভারত বুলেট ট্রেন পেতে চলেছে’— আপনারা নিশ্চয় এই স্লোগানটি শুনেছেন। এই স্লোগানের উদ্যোক্তা প্রধানমন্ত্রী নিজে। লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয়ে এমন ট্রেন নাকি তাঁদের স্বপ্ন। কিন্তু তেমনই সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে তাঁদের উচ্চবাচ্য নেই। সম্প্রতি বুলেট ট্রেন হচ্ছে না বলে চালানো হচ্ছে ‘বন্দে ভারত’। যে শতাব্দী ট্রেন জওহরলাল নেহরুর শতবর্ষ স্মরণে চালানো হয়েছিল সেটাকে আস্তে আস্তে হটিয়ে ‘বন্দে ভারত’ জায়গা করে নেবে অথবা করে দেওয়া হবে এটাই তাদের উদ্দেশ্য। তবে এখন ‘বন্দে ভারত’ ট্রেনের যা অবস্থা সেটাও খুব আহামরি নয়। আর এই ট্রেন চালু করার জন্য অন্য বহু ট্রেনের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। (Balasore Train accident)
আমরা বলতাম রেল একটি ‘প্রতিষ্ঠান’। আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান। রেল নিজেই তার ব্যবহারে প্রয়োজন হয় এমন কিছু সব তৈরি করে। এমনকী তাদের ছাপাখানাও আছে। পশ্চিমবাংলাতেই তাদের বড় ছাপাখানাটি ছিল। সেটা-সহ সব তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন সেখান ‘আউটসোর্সিং’ চলছে। রেলে যে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার ছিল তা আর নেই। আসলে পোষা পুঁজিপতিদের কাছে রেলকে বিক্রি করা হচ্ছে। রেলের রক্ষণাবেক্ষণ, যাত্রী-সুরক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্য এখন প্রাইভেট হাতে দেওয়া হচ্ছে। খাবারদাবারও। একটার পর একটা রেলস্টেশন প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে রেলযাত্রীদের সুরক্ষা নেই বললেই চলে। সে-কারণে এতবড় বিপর্যয় এড়ানো যায়নি। এর জবাব কেন্দ্রীয় সরকারকেই ভারতবাসীর সামনে দিতে হবে।
রেলের শূন্যপদে ইদানীং কোনও লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না। রেলের গ্যাংম্যান, যাঁরা পায়ে হেঁটে ডিউটি করেন। যাঁরা নিরাপত্তা রক্ষার প্রধান কারিগর। রেল ঠিক করেছে গ্যাংম্যান আর রাখবে না। কারণ প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। পয়েন্টম্যানও রাখবে না। সীমিতসংখ্যক চালক দিয়ে রেল চালাবে। এটা কেবল মুর্খামি নয়— দেশের মানুষের উপর বিশ্বাসঘাতকতা, চালক কম থাকার ফলে একনাগাড়ে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে। ফলে ‘হিউম্যান এরর’ হওয়া স্বাভাবিক। আমার মনে পড়ছে রেল স্ট্যান্ডিং কমিটি সুপারিশ করেছে ‘হিউম্যান এরর’ কমাতে হবে। তার জন্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। কর্মী ছাঁটাই করে সেটা করা সম্ভব নয়। একটা হিসাবে দেখলাম রেলে প্রায় ৪ লক্ষ স্বীকৃত পদ ফাঁকা আছে। এভাবে এতবড় প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে মোদি সরকারকে।
আমাদের ‘বুলেট ট্রেন’ তথা দ্রুতগতির কথা বলে এতবড় দুর্ঘটনা হয়ে যাবার পর অকুস্থলে রেলমন্ত্রী এলেন ১৩ ঘণ্টা পর! তাহলে কেমন দ্রুতগতি বোঝা যাচ্ছে! তিনি আবার ওড়িশার মানুষ!
পশ্চিমবাংলার অনেক মানুষ প্রয়াত (Balasore Train accident)। আহত। মুখ্যমন্ত্রী দুপুরেই পৌঁছে গিয়েছিলেন সেখানে। সব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আসল প্রশ্নটি তিনি তুলেছেন— মানুষের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার তথা রেল দফতরকে। বর্তমানে রেল দফতরকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। রেল বাজেট আর আলাদা করে পেশ হয় না। সাংসদেরা বক্তব্য রাখতে পারেন না। পুরো স্বৈরতন্ত্র চলছে। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না। আমরা তা হতে দেব না। এই বিপর্যয় থেকেই আমাদের শপথ নিতে হবে— কেন্দ্রীয় সরকারের এই মানুষ-মারার প্রক্রিয়াকে ঠেকাতে হবে। তাদের উচিত শিক্ষা দেবার প্রহর গুনছি আমরা। দেশের কোটি কোটি মানুষ।
আরও পড়ুন: রুজিরাকে আটকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে উপেক্ষা করল এজেন্সি