প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস (World Environment Day) পালন করা হয় ৫ জুন ১৯৭৩। পৃথিবীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতি বছর এই দিনে অঙ্গীকার করা হয়। গাছ পরিবেশ রক্ষার প্রথম সৈনিক। তাই স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাপকভাবে মাটিতে গাছ লাগিয়ে এই দিন উদযাপন করে। পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোই এই দিনের মূল উদ্দেশ্য। এই গোটা মাসটাই বিশ্ব পরিবেশ মাস হিসেবে সকলে পালন করবে। কিন্তু শুধু পালন করলেই হবে না চাই সচেতনতা।
পৃথিবীর জটিল পরিবেশ বা জলবায়ু যা একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলে, তাদের মোটামুটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়—
১) বায়ুমণ্ডল বা পৃথিবীর উপরিভাগের বায়ুস্তর।
২) পৃথিবী-বেষ্ঠিত জলরাশি।
৩) মেরুপ্রান্তে অবস্থিত বরফরাশি।
৪) মাটি বা পাথুরে অংশ এবং
৫) সম্পূর্ণ প্রাণিজগৎ বা জীবজগৎ। এদের যে কোনও একটিতে কোনও ঘাটতি হলে তা অন্যগুলির উপরেও প্রভাব বিস্তার করবে। আর এই ঘাটতি তৈরি করতে তাপ অতুলনীয়।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ : জলবায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ তিনটি। পৃথিবীর অভন্তরের গঠন, পৃথিবীর দিকে আসা সূর্যের তাপপ্রবাহ এবং জলবায়ুর উপরিলিখিত নিজের পাঁচটি অংশের অবিরত এক থেকে অন্যত্রে অনুপ্রবেশ বা রূপান্তর।
পৃথিবীর অভ্যন্তর : পৃথিবীর (World Environment Day) অভ্যন্তর নানা রকম স্তরে গঠিত। মধ্যাংশের তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গলিত তরল অবস্থায় আছে। কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে পৃথিবীর ভেতরের গলিত তরল যথাক্রমে আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের আকারে পৃথিবীর ওপরে চলে আসে এবং সমুদ্র বা জলবায়ুর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলের কাছে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এরই উদহারণ। এই ঘটনায় ওই অঞ্চলের সমুদ্রের তলদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য নানা রকম প্রোটিনসমৃদ্ধ জীবজগৎ সমুদ্র সমতলে ভেসে ওঠে এবং আহার হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। এই ঘটনাকে এল-নিনো বা ক্রাইস্ট-চাইল্ড বলা হয়। ২ থেকে ৮ বছর বাদে বাদে পুনরাবৃত্তি হয়। এই ঘটনায় সমগ্র সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। আবার যখন সমুদ্রের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়, তখন তাকে লা-নিনা বলে। এল-নিনো-প্রসূত তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বায়ুমণ্ডলের উপর বাষ্পায়নের প্রভাবকে এল-নিনো সাউদার্ন অসিলেশন বা এনসো বলে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গরম থেকে ঠান্ডা জায়গায় তাপ পরিবহণের জন্য নানা ধরনের উলম্ব ঘূর্ণন গতি আছে। যেমন বিষুব অঞ্চল থেকে মেরু প্রান্তে তাপ পরিবহণের জন্য হেডলি সেল, ফেরারেল সেল এবং পোলার সেল। এগুলিকে মেরিডিওনাল সার্কুলেশন বলে। তেমনি বিষুবরেখা-বরাবর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাপপ্রবাহের জন্য উলম্ব ঘূর্ণন গতিকে ওয়াকার্স সার্কুলেশন বলে। একে জোনাল সার্কুলেশনও বলা হয়। এনসো ঘটনার জন্য উলম্ব তাপগতির সমস্ত মেরিওডিওনাল ও জোনাল সার্কুলেশন বিঘ্নিত হয়। যে জায়গায় বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী গতি হওয়ার কথা, সেখানে বায়ুর নিম্নমুখী গতি হয় অর্থাৎ বৈপরীত্য। আর যেখানে বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী গতি সেখানে নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হবে এবং বৃষ্টিপাত-সহ নানা ঘটনা ঘটবে। কিন্তু যেখানে বায়ুর নিম্নমুখী গতি সেখানে বায়ুর উচ্চচাপ অঞ্চল তৈরি হবে এবং ফলস্বরূপ খরা ও মরুভূমি হওয়ার সম্ভাবনা। এনসোর প্রভাবে জায়গায় বিশেষে খরা, বন্যা-সহ অপরিণত মনসুন, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি ও নানাবিধ প্রাকৃতিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
সূর্যের প্রভাব : সূর্য থেকে দিনের বেলায় আমরা যে আলো ও তাপ পাই সেটা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৫ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত ওজোনস্তরের মধ্যে দিয়ে আসে। এই ওজোনস্তরের একক হচ্ছে ডবসন। ১০০ ডবসন ১ মিলিমিটার পুরু ওজোনস্তরের সমান। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে, বায়ুমণ্ডলে ওজোনের পরিমাণ ২৫০ থেকে ৩০০ ডবসন একক হওয়া উচিত। এই ওজোনস্তর সূর্যকিরণের দূষিত (অতিবেগুনি রশ্মি ইত্যাদি) অংশ শোষণ করে এবং জীবজগৎকে রক্ষা করে। CFC (ক্লোরো ফ্লোরও কার্বন), HFC (হাইড্রো ফ্লোরও কার্বন) ইত্যাদি গ্যাসের জন্যেও বহির বিশ্ব থেকে আসা তড়িৎকণা ও পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে মেরু অঞ্চলে ওজোনস্তরের ঘাটতি দেখা যায়। সতর্কতা অবলম্বনের পর এখন ওজোনস্তরের ঘাটতি অনেকটাই পুনরুদ্ধার হয়েছে।
উন্নত মানবজাতি : আমাদের পরিবেশের (World Environment Day) সবথেকে উন্নত মানবজাতি। যাঁরা পরিবেশের মধ্যে থেকে উল্লিখিত জলবায়ুর পাঁচটি অংশকেই ব্যবহার করে। শিল্প-উন্নয়ন, নগর-উন্নয়ন ও দৈনিক জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য যে বিশাল কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত চালাতে হচ্ছে তা বিশ্ব উষ্ণায়ানের প্রধান কারণ। শক্তি বা তাপের জন্য মানুষ নানাবিধ জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন কয়লা, পেট্রোল ইত্যাদির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়িয়ে যাচ্ছে। এখান থেকেই নানারকম গ্রিনহাউস গ্যাস (মিথেন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, কার্বন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, CFC, HFC, ওজোন) উৎপন্ন হয়। পরিবেশ বিজ্ঞানারীরা দেখছেন কার্বন শুট বা অর্ধদহন কার্বন তাপ ধরে রাখে এবং পরিবেশ উত্তপ্ত করে। এই কার্বন এমিশনের কুফল মারাত্মক।
সচেতনতা : ৬তম ইন্টার গভর্মেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) সময়ের সাপেক্ষে নানাবিধ কার্বন এমিশনের তথ্য ও সমুদ্রসমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি বিশ্লেষণ করে রিপ্রেসেন্টেটিভে কন্সেন্ট্রেশন পাথওয়েস সংক্ষেপে RCP একটি আদর্শ লেখচিত্র তৈরি করেছে। কার্বন এমিশন তথা উষ্ণায়নের জন্য মেরু অঞ্চলের বরফ গলা জলে সমুদ্রতলের উচ্চতা প্রতি বছর ১.৭ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাবার কথা কিন্তু তা এখন ৩.৭ মিলিমিটার করে বাড়ছে প্রতি বছরে। এর প্রভাবে বিষুবরেখা অঞ্চলে তাপ ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। ওই অঞ্চলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং ট্রপোস্ফিয়ারের উচ্চতা বেড়ে যাবে। ট্রপিকাল রিজিওনে ঝড়, সাইক্লোন, সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দুর্যোগ বেড়ে যাবে।
প্রতিকার : সুপরিকল্পিত ভাবে উপকূলবর্তী পশ্চিমবঙ্গে সুদূরপ্রসারী সুপ্রস্থ রিং রোড ও সার্ভিস রোড সমেত সবুজ বন্দর, সবুজ বিমানবন্দর, সবুজ শিল্পায়ন ও সবুজ শহরের (২০০ কিমি লম্বা x ১০ কিমি চওড়া) প্রণয়ন, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যানবাহন হবে সবুজ। গড়তে হবে পর্যাপ্ত সবুজ শিক্ষাকেন্দ্র ও চিকিৎসাকেন্দ্র আর বাধ্যতামূলক ব্যাপক ম্যানগ্রোভ রোপণ। চাই সবুজ মানসিকতা।
আরও পড়ুন: রুজিরাকে আটকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে উপেক্ষা করল এজেন্সি