কুণাল ঘোষ : মেদিনীপুরের কর্ণগড় ঘুরে এসে মা মহামায়া আর মা অভয়া রূপে দুর্গাপুজো চলছে রানি শিরোমণির মন্দিরে। মেদিনীপুর শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কর্ণগড়ে রানির মন্দিরে। লালমাটির দেশে, জঙ্গলমহলের ল্যান্ডস্কেপে।
পুজো তো হচ্ছে, নিত্যপুজো হয়, দুর্গাপুজোর কদিন কোভিড বিধি মেনেও একটু বড় করে। কিন্তু কার পুজো, কার মন্দির, সেটা বোধহয় আলোচনা দরকার। বারবার। জায়গার নাম কী? কর্ণগড়। মন্দির কার? রানি শিরোমণির। কে এই রানি শিরোমণি?
তিনি বাংলার একজন আদিবাসী মহিলা, যিনি ঘটনাচক্রে রানি হন। রাজা অজিত সিংয়ের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী।
রানি শিরোমণির আলাদা গুরুত্ব কোথায়? কারণ, তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু সে তো ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈও করেছিলেন, তিনিই তো দেশের প্রথম মহিলা বিদ্রোহিনী। এখানেই তো সমস্যা। রানি লক্ষ্মীবাঈ যুদ্ধ করেন 1857 সালে। আর রানি শিরোমণি 1797 সালে, অর্থাৎ 60 বছর আগে। তিনিই প্রথম মহিলা বিদ্রোহিনী। তাহলে?
তাহলে সেটাই তো কথা। দেশের প্রচলিত ইতিহাসের লেখকরা বাংলার জঙ্গলমহলবাসিনীকে স্বীকৃতি দিলেন না কখনও। কাহিনিটি এরকম- ১৭৯৬/ ৯৭। জঙ্গলমহলে চূয়াড় বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ মাথা তুলছে। বৃটিশ দখল নিতে চাইছে এলাকার। প্রতিরোধে কিছু বিচ্ছিন্ন লড়াই। ঠিক সেইসময় কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি। লক্ষ্মীবাঈর সঙ্গে মিল আছে কিছু। রাজার মৃত্যু হয়েছে। নিঃসন্তান শিরোমণি দায়িত্বে। ব্রিটিশ বলছে এলাকা দিয়ে দাও। শিরোমণি নারাজ। ব্রিটিশ এলো দখল করতে। যেহেতু শিরোমণি নিজে আদিবাসী রমণী ছিলেন, রাজা কোন্ এক পছন্দের মুহূর্তে তাঁকে এনে বিয়ে করেছিলেন, ফলে জঙ্গলমহলের বিদ্রোহী চূয়াড় নেতাদের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছিলেন শিরোমণি। তাঁকে মেনে নেয় সবাই।
আরও পড়ুন : চেন্নাইয়ের পুজো মণ্ডপে ‘জাগো বাংলা’-র উৎসব সংখ্যা, তুঙ্গে চাহিদা
ব্রিটিশের ছিল কামান, বন্দুক, ঘোড়া। শিরোমণিদের শুধু লাঠি। তবে জঙ্গলমহলের গ্রামের পর গ্রামে শিরোমণির নির্দেশ, ব্রিটিশদের খাবার, জল, আশ্রয় দিলে কড়া শাস্তি।
যুদ্ধ হল বটে। অনভ্যস্ত জঙ্গলমহলে টিকতে পারল না ব্রিটিশরা। শেষে সেই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসআচমকা রানি বন্দি। প্রিয় মন্দির থেকে। তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক ধরিয়ে দিল, নাকি রাজত্বের লোভে ধরিয়ে দিল নায়েব, মতভেদ আছে। কিন্তু কর্ণগড় গেল ব্রিটিশদের হাতে। রানি বন্দি।
বিচার ইত্যাদি হল। সম্ভবত বন্দিদশাতেই রানির মৃত্যু।
এই হল কর্ণগড়ের ইতিহাস। আজও আছে রাজবাড়ির, যেটা রীতিমত কেল্লা, তার উপেক্ষিত ধ্বংসস্তূপ। পারাং নদী দিয়ে ঘেরা। কেউ সংরক্ষণের কথাও ভাবেনি। একবার জিওলজিকাল সার্ভের টিম এসেছিল। ওই পর্যন্তই। এপারে রানির প্রিয় মন্দির। মা মহামায়া, মা অভয়ার প্রাচীন মূর্তি। ভারতের প্রচলিত ইতিহাসের রচয়িতারা লক্ষ্মীবাঈকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু বাংলার আদিবাসীকন্যাকে উপেক্ষিত রেখেছেন। অপ্রচলিত ইতিহাসের কিছু বইতে রানির উল্লেখ অবশ্য সসম্মানেই আছে।
বহুবছর আগে বিষয়টি সামনে আসায় তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রানিকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি ট্রেনের নাম রেখেছিলেন শিরোমণি এক্সপ্রেস। তখন বাম সরকারও কিছু উদ্যোগ নেন। অনিল বিশ্বাস কর্ণগড় দেখতেও গিয়েছিলেন। আরও কয়েকজনের কিছু উদ্যোগ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে ট্রেনের নামকরণ। এখনও কর্ণগড় একরাশ স্মৃতি বুকে নিয়ে একইভাবে আছে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন পৌঁছেছে এলাকায়। লালমাটির অপূর্ব পরিবেশে গড়ে উঠছে পর্যটকদের ঠিকানাও।মন্দির ঘিরে আরও মানুষ সক্রিয়। পুরোহিত শঙ্কর ভট্টাচার্য দীর্ঘকাল মন্দির সামলে এসেছেন। বাংলার সেই ইতিহাসে উপেক্ষিত রানি শিরোমণির ক্ষুধিত পাষাণের মন্দিরে আজও চলছে পুজো।মহামায়া, অভয়া রূপে মা দুর্গার আরাধনা। কর্ণগড় আজও গর্বিত তাদের মেয়ে, তাদের রানি শিরোমণিকে নিয়ে।