বিশ্ব উষ্ণায়ন কী
ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (National Oceanic and Atmospheric Administration) বা NOAA জানাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য মূলত দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস।
সূর্যই যে পৃথিবীকে আলো এবং তাপ দেয় একথা কে না জানে। সূর্যের আলোতেই পৃথিবী গরম হয়। কিন্তু সমস্যা হল বায়ুমণ্ডলে যেসব গ্যাস রয়েছে তা পৃথিবী থেকে এই তাপকে বেরতে দেয় না। আর অন্যদিকে দিনে দিনে বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধি পাচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড-সহ অন্যান্য গ্যাস। এর ফলে পৃথিবী অনেক বেশি পরিমাণে তাপ ধরে রাখছে। কোনওটাই পৃথিবী থেকে বেরতে পারছে না। ফলে ধীরে ধীরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমাগত পৃথিবীর এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকেই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলা হয়।
গবেষণা অনুযায়ী তাপমাত্রার এই বিপজ্জনক বৃদ্ধি এড়াতে বিশ্বকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, তা নাহলে শীঘ্রই বিপদে পড়বে ভূমণ্ডল। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ঝুঁকি যদি এড়ানো না যায় তবে অদূর-ভবিষ্যতে ভূপৃষ্ঠের আবহাওয়া মারাত্মক রূপ ধারণ করবে।
নাসার গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ ওয়েবসাইট বলছে— ‘শিল্পযুগের আগে (আনুমানিক ১৮৫০-১৯০০ সাল) মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপ, জীবাশ্ম জ্বালানীর দহনের কারণে বায়ুস্তরে আটকে পড়া গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তাই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং।’
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণ
আসলে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ এই প্রশ্নটা আজ ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। উত্তর হল বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ডেকে এনেছে অভিশাপ যা এই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। বিজ্ঞানের সমুদ্রমন্থনে অমৃতের সঙ্গে উঠছে ঝাঁঝাল বিষ।
বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী মানুষের কর্মকাণ্ড। প্রতিদিন পুড়ছে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা। নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড। বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের ব্যবহারে পুড়ছে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি, পুড়ছে গ্যাস। কল-কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন— সবকিছুতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে।
মিথেনের পরিমাণ বৃদ্ধি। গাছপালার পচন, কৃষিজ বর্জ্য এবং জীবজন্তুদের বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
CFC-র ব্যবহার। এটি একটি বিশেষ যৌগ যা ওজোন স্তরের ক্ষতির জন্য দায়ী। এই CFC প্রধানত রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, ফোম শিল্প, রং শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, সুগন্ধী শিল্প, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিট পরিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে নির্গত হয়।
কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, যানবাহন, নাইলন শিল্প প্রভৃতি কলকারখানা-যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, ট্যানারি কারখানার বর্জ্য পদার্থ, জেট বিমান, রকেট উৎক্ষেপণ, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র প্রভৃতি থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা নির্গত হয় এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণকারী গাছ কেটে ফেলছি নিমেষে। অরণ্য-ছেদনে বাতাসে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইড।
কিছু প্রাকৃতিক কারণ
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের অন্যতম কারণ আগ্নেয়গিরি। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় নির্গত ছাই এবং ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলে চলে যায় এবং জলবায়ুকে প্রভাবিত করে।
পার্মাফ্রস্ট। যেখানে হিমবাহ রয়েছে। এটি একটি হিমায়িত মাটি যাতে বেশ কয়েক বছর ধরে পরিবেশগত গ্যাস আটকে থাকে। পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি বায়ুমণ্ডলে গ্যাসগুলিকে ছেড়ে দেয় এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।
দাবানল প্রচুর পরিমাণে কার্বনযুক্ত ধোঁয়া নির্গত করে। এই গ্যাসগুলি বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয় এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হয়।
নাসার গোদার্দ ইনস্টিটিউট ফর স্পেন স্টাডিজের হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম বছর। কিন্তু ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট ও ক্লাইমেট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, উষ্ণতম বছর হল ১৯৯৮ সাল এবং দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হল ২০০৫ সাল।
মনে করা হচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবী কুড়ি লক্ষ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গরম হয়ে যাবে।
উষ্ণায়নের ফলে
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বিষুবীয় ও মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে, আর ১০০ বছরের মধ্যে হিমশৈল-সহ সুমেরু-কুমেরুতে জমে থাকা সমস্ত বরফ জলে পরিণত হবে। শীতে শুধুমাত্র অল্প বরফ থাকবে।
ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার ফলে বিষুবীয় ও মেরু অঞ্চলের জমে থাকা বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জলস্তর ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে। এর ফলে পৃথিবীর উপকূলবর্তী এলাকার (ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ-সহ) একটি বিরাট অংশ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। ম্যালেরিয়া, গোদ, কলেরা, ডেঙ্গু প্রভৃতি রোগের প্রকোপ বাড়বে। কারণ, জল বাড়লে মশা বাড়বে। আরও নানান রোগ ফিরে আসবে। নতুন নতুন রোগও যোগ হবে।
বিশ্ব জুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাদের অনেকগুলি প্রজাতি বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে।
বন্যজন্তুর সংখ্যা হ্রাস পাবে সঙ্গে বনাঞ্চল কমবে।
কী করে রক্ষা মিলবে
বিশ্ব উষ্ণায়নের হাত থেকে রক্ষার উপায় সেই মানুষের কর্মকাণ্ডে লাগাম। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে হাঁটা, সাইক্লিং বা গণ-পরিবহণের ব্যবহার কার্বন-নির্গমণ কমিয়ে আনবে।
গাছ লাগানোর মাধ্যমেই আমরা পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারি। কারণ পৃথিবীতে গাছই একমাত্র কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ত্যাগ করে। তাই বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। বনভূমির হ্রাসও গাছ লাগিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে।
এ-ছাড়া দূরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে উড়োজাহাজের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক বাহন ব্যবহার করুন বা ট্রেনযাত্রাকে বেছে নিন।
ঘর ঠাণ্ডা করতে এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চাইতে বাড়িয়ে রাখুন। এবং ঘর গরম করতে হিটারের তাপমাত্রা কমিয়ে ব্যবহার করুন।
জীবাশ্ম জ্বালানি, রাসায়নিক সার ব্যবহার কমাতে হবে ও মিথেন নির্গমণের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে।
বিকল্প ও পরিবেশবান্ধব দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে।
যেসব বৈদ্যুতিকসামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে না সেগুলো আনপ্লাগ করে সুইচ বন্ধ করে রাখুন।
আরও পড়ুন- কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা-চর্চায় প্রমাণিত বাংলায় নওশাদ বিজেপির এজেন্ট