ডাক্তারি ছেড়ে অভিনেতা
ছোট থেকেই লেখাপড়ায় তুখড়। দাদু ছিলেন ডাক্তার। সেই কারণে বাবার ইচ্ছেয় ১৯৫৩ সালে ভর্তি হন মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৬০-এ এমবিবিএস পাশ করেন। চিকিৎসক হিসেবে প্রথমে সিভিল ডিফেন্স ও পরে কলকাতা পুরসভায় যোগও দেন। কিন্তু মন পড়েছিল অভিনয়ে। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারির পেশা ছেড়ে চলে আসেন রঙ্গমঞ্চে। ডাক্তারি পড়তে পড়তেই আইপিটিএ–তে যোগ দিয়েছিলেন। মঞ্চে তাঁকে দেখেই পরিচালক মৃণাল সেন তাঁকে ‘আকাশকুসুম’-এ ডাকেন। ছবি মুক্তির পরেই পরিচালকদের নজরে পড়েন শুভেন্দু (Subhendu chatterjee)। সে-তালিকায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও।
রাইভাল উত্তম
উত্তমকুমার যখন ম্যাটিনি আইডল হতে শুরু করেছেন, তখনই বাংলা ছবিতে আবির্ভাব অতি-সুদর্শন অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের (Subhendu chatterjee)। ফলে বারবার তুলনা হয়েছে। এমনকী, একসময় শুভেন্দুকে উত্তমকুমারের ছায়া বলেছেন সমালোচকরা। কিন্তু তিনি যে ছায়া নন, তাঁর কায়া পর্দায় সেটা ভালই বুঝিয়েছে। বিশেষ করে ‘চৌরঙ্গী’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘চিড়িয়াখানা’র মতো ফিল্মে মহানায়কের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেও আলাদাভাবে নজর কাড়েন শুভেন্দু। আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক? ‘চিড়িয়াখানা’র শ্যুটিং চলাকালীন ফ্লোরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তমকুমার। মহানায়কের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বুঝতে পারেন ‘ডাক্তার’ শুভেন্দু। কিন্তু সেটা উত্তমকুমারকে না বলে ওষুধ খাইয়ে সাথে সাথেই ডাঃ সুনীল সেনকে কল করেন শুভেন্দু। এই ঘটনার পরে, তাঁর উপর খুবই ভরসা করতেন উত্তম। অসুস্থ হলেই শুভেন্দুর মতামত নিতেন।
আরও পড়ুন- ইদের বার্তা ইদের শিক্ষা
সত্যজিতের পছন্দের
অভিনয় জীবন শুরু হয় মঞ্চে নাটক দিয়ে। অভিনয় শিক্ষা অভিনেতা জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। আইপিটিএ আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন শুভেন্দু। আইপিটিএ-এর মঞ্চেই ১৯৬৫-তে তাঁকে দেখে পরিচালক মৃণাল সেন ‘আকাশকুসুম’ ছবির জন্য ভাবেন। সেই ছবি মুক্তি পাওয়ার পরে পরিচালকদের নজরে পড়েন শুভেন্দু। সেই বছরই মুক্তি পায় তাঁর অপর ছবি ‘কাঁচ কাটা হীরে’। নজরে পড়েন সত্যজিৎ রায়ের। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে ডাক পান শুভেন্দু। মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে একই সঙ্গে এই ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এরপরে, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘গণশত্রু’তে তাঁকে কাস্ট করেন সত্যজিৎ।
তবে, শুধু সত্যজিৎ নন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ— সবার ছবিতেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যায় শুভেন্দুকে। সমান্তরাল ছবির পাশাপাশি চুটিয়ে অভিনয় করেছেন মেন স্ট্রিম বাংলা ছবিতে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নায়কের চরিত্র থেকে সরে আসেন চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘লাল দরজা’ ছবির জন্য আনন্দলোক সেরা অভিনেতা পুরস্কারও পান। লাল দরজা ছবি সে-বছর সেরা ফিল্মের জাতীয় পুরস্কার পায়। তবে, তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল দর্শকদের ভালবাসা।
সেটে প্রেম
নিতান্ত ফ্যামিলি ম্যান বলেই পরিচিত ছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। বই পড়ে, ভাল ছবি দেখে, পরিবারের সঙ্গে বেড়িয়ে অবসর যাপন ছিল তাঁর। যদিও কাজের চাপে সেই সময় খুবই কম পেতেন। আর ছিল আরেক বিখ্যাত অভিনেতা রবি ঘোষের বাড়িতে তিনপাত্তি খেলা। কলকাতায় রাজ কাপুর আসায় বাংলা ছবির প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় একটি পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দিয়েছিলেন। সেই পার্টিতে রাশিয়ান ব্যালে শিল্পী রাবিনকিনার সঙ্গে আলাপ হয় শুভেন্দুর। ‘মেরা নাম জোকার’ ছবিতে কাজ করেছিলেন রাবিন। সেখানে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন বলিউডের আরেক আবেদনময়ী অভিনেত্রী সিমি গ্রেওয়াল। ভাল বন্ধু হয়ে যান তাঁরা। সিমির কাছেই শুভেন্দুকে ভাল লাগার কথা জানান রাবিন। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং ফ্লোরে সেকথা সবার সামনেই বলে দেন সিমি। শুধু তাই নয়, রাবিনের একটি ছবিও শুভেন্দুকে দেন অভিনেত্রী, যার পিছনে লেখা ছিল, “টু শুভেন্দু, টু অল মাই হার্ট”। এই সব শুনে সকলে হেসে কুটোপাটি। আর এসবই হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের সামনে। শুভেন্দুর চোখ-মুখ লজ্জায় লাল। সত্যজিতের সরস মন্তব্য ছিল, ‘‘‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তা হলে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠাই, কী বলো শুভেন্দু?’’ এই কথা অবশ্য বাড়িতে লুকোননি অভিনেতা।
অভিনেতা-চিকিৎসক
চিকিৎসক হতে চাননি। চেয়েছিলেন অভিনেতা হতে। হয়েও ছিলেন বাংলার ছবির প্রথমসারির অভিনেতা। তবে, ডাক্তারিটা ভোলেননি। প্রয়োজনে সেটা কাজেও লাগাতেন। ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ ছবির শুটিংয়ের গঙ্গোত্রী থেকে যমুনোত্রী পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে গিয়েছিল পুরো শ্যুটিং ইউনিট। সেই সময় বহু পাহাড়ি মানুষের চিকিৎসা করে শুভেন্দু (Subhendu chatterjee)। তাঁদের কাছে অভিনেতা নন, ডাক্তারবাবু হিসেবেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। একজন বৃদ্ধের পায়ের ক্ষত দেখে শিউরে ওঠেন ডাক্তার শুভেন্দু। বুঝতে পারেন পরিস্থিতি ভাল নয়। তবু, সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেই তাঁর চিকিৎসা করেন। ফেরার পথে দেখেন একবাটি ছাগলের দুধ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ। কারণ, তাঁর পায়ের ক্ষত সম্পূর্ণ সেরে গিয়েছে। গরিব পাহাড়বাসীর ডাক্তারবাবুকে দেওয়ার মতো ফি নেই। ভালবেসে সেই দুধ খেয়েছিলেন শুভেন্দু।
সিনেমার পাশাপাশি
মঞ্চ দিয়ে অভিনয়ের জীবন শুরু। এরপর আসেন পর্দায়। তবে, এই দুই মাধ্যমেই নয়, কমার্শিয়াল থিয়েটার, যাত্রাতেও অভিনয় করেছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। ‘কালবৈশাখী’, ‘অমরকণ্টক’, ‘বধূবরণ’-এর মতো কমার্শিয়াল নাটক, ‘এমন একটা মানুষ চাই’, ‘নকল স্বামীর ঘর’-এর মতো যাত্রা করেন তিনি। ছোটপর্দাও ব্রাত্য ছিল না তাঁর কাছে। ‘ডঃ মুন্সির ডায়েরি’, ‘এই তো জীবন’— এইসব সিরিয়ালেও দেখা যায় শুভেন্দুকে। তবে, আজও বাংলা ছবির দর্শক তাঁকে মনে রেখেছে তাঁর কাজ, তাঁর পর্দার উপস্থিতিকে।