আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল মানুষজন, সবাই একই নৌকার সওয়ারি। সংবিধানের ৪৪ নং ধারায় যে নির্দেশমূলক নীতির কথা বলা আছে, তদনুসারে এঁরা সবাই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির (uniform civil code) পক্ষে। তা ছাড়া শীর্ষ আদালতও তো একাধিকবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এ-পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। কিন্তু প্রগতিশীল দৃষ্টিকোণ থেকে অভিন্ন দোওয়ানি বিধিকে যেভাবে দেখা হচ্ছে, সেই একইভাবে কি বিষয়টাকে মোদিজি ও তাঁর সাকরেদরা দেখছেন? বোধ হয় তেমনটা নয়।
প্রগতিশীল ভারতীয়রা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি দায়বদ্ধ। পক্ষান্তরে মোদিজি ও তাঁর সাকরেদরা হিন্দুত্বের প্রতি দায়বদ্ধ। সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী। দুটি বিন্দু এক হবে কী করে?
অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে যখন একজন প্রগতিশীল ভারতীয় সমর্থন করেন, তখন তাঁর মাথায় থাকে একটাই ভাবনা। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে সকল ভারতীয় নাগরিকের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ ও লিঙ্গনিরপেক্ষ আইন বলবৎ হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বচন শুনলে মনে হবে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তাঁর কাছে অন্তত ‘মুসলিম বেটি-বহেন’দের মুক্তির ঠিকানা। মনে হবে, মুসলমান নারীদের যাবতীয় সমস্যার ভরকেন্দ্রে বিরাজ করছে মুসলমানদের পরিবার আইন।
যদি ধরে নিই, অবশ্যই তর্কের খাতিরে, যে মুসলমান পরিবার আইন ভয়ঙ্কর রকমের অন্যায় একটা বিধি, পুরোদস্তুর নারীবিরোধী একটা বিষয় এবং সেটির আশু সংস্কার আবশ্যক, তাহলেও কি মুসলমান মা-বোনেদের চোখের জল মুছিয়ে ফেলার তাবৎ বন্দোবস্ত হয়ে যাবে?
না, যাবে না। মুসলমান পরিবারিক আইনের সংস্কার করে মুসলমান মা-বোনদের যন্ত্রণার উপশম ঘটানো যাবে না।
যাবে না, কারণ বিলকিস বানোর প্রতি যে অন্যায় হয়েছে সেটা মুসলমান পারিবারিক আইনের কারণে হয়নি।
যাবে না, কারণ বুলডোজার বাবা কিংবা বুলডোজার মামলার সৌজন্যে যেসব মুসলমান মা-বোন স্বজনকে হারিয়েছেন, মাথার ওপর ছাদ হারিয়েছেন রাতারাতি, তাঁদের দুরবস্থার জন্য কোনওভাবেই মুসলমান পারিবারিক আইনকে দায়ী
করা চলে না।
যাবে না, কারণ, গেরুয়া গোরক্ষক বাহিনীর মার খেয়ে প্রাণ হারিয়েছেন যাঁদের স্বামী-পুত্রেরা তাঁদের অশ্রুধারার কারণ মুসলমান পারিবারিক আইন নয়।
যাবে না, কারণ গৈরিক বাহিনী ‘মুসলমান মেয়েদের ধর্ষণ করো’ ফরমান জারি করায় যেসব নারী দুর্দশা কবলিত, তাঁদের দুরবস্থার কারণ কোনওভাবেই মুসলমান পারিবারিক আইন নয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে ২০১৪-তে বহুবার শুনেছি ‘সবকা সাথ সাবকা বিকাশ’। কিন্তু একবারও কি শুনেছি ‘নির্যাতিতা মুসলমান বহেন-বেটি’দের আশ্বস্ত করার মতো কোনও শব্দবন্ধ?
মুসলমান নারীদের শৃঙ্খলমুক্তি একটি জরুরি বিষয়, সন্দেহ নেই। মৌলবাদীদের হাত থেকে তালিবানদের হাত থেকে তাঁদের বাঁচানো দরকার, এটাও মানা গেল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যে আসন্ন ভোটের দিকে লক্ষ্য রেখে মেরুকরণের তাস খেলবেন বলেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে শোরগোল তুলতে চাইছেন, সেটাও তো অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
১৯৯০-এর দশকের শেষ পাদ থেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (uniform civil code) গেরুয়া ব্রিগেডের তিনটি অ্যাজেন্ডার অন্যতম। বাকি দুটি হল, বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ এবং ৩৭০ ধারা বাতিল। মেরুকরণের লক্ষ্যে বাকি দুটো অ্যাজেন্ডার কাজ সারা হয়ে গিয়েছে। পড়ে আছে আর মাত্র একটি। সেটি পূরণ হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়। তাই এত হইচই।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ঠিক কেমন হবে সেটা কিন্তু এখনও কেউ জানে না। জনসমক্ষে কোনও খসড়া পেশ করেনি মোদি সরকার। নিঃসন্দেহে ইচ্ছাকৃত কাজ এটি। উদ্দেশ্য তো একটাই। ভোট আসছে। সুতরাং, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে হইচই বাধিয়ে দাও। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর একাংশ তো ‘এটা সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মুখ লুকোবে। আর মুসলমান মৌলবাদীরা আওয়াজ তুলবে, শরিয়তি আইনে কারও নাক গলানো বরদাস্ত করব না। এরকম পরিস্থিতিতে যারা যথাযথ ধর্মনিরপেক্ষ দল তাদের ‘মুসলমান তোষণকারী’ বলে দেগে দেওয়া যাবে।
মেরুকরণ নিশ্চিত করার এর চেয়ে ভাল প্রেক্ষাপট আর কী হতে পারে!
আগামী কয়েক মাস একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেসব রাজ্যেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ইস্যু তুলে মেরুকরণ সুসম্পন্ন হতে পারে। সেজন্যই মোদিপক্ষ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন। মুসলমান নারীর স্বাধিকার, সম্মান, যন্ত্রণা-উপশম, এসব কেবল ছলনা। গেরুয়াপক্ষের রেকর্ড তাই বলে।
আরও পড়ুন- ইডেনে বিশ্বকাপ ম্যাচ: রোহিতদের ম্যাচে টিকেটের দাম বেশি