(গতকালের পর)
সংবিধান অনুযায়ী (৩৭১সি) মণিপুরে আলাদা আইন। প্রায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। বিয়ের পর বর কন্যার বাড়ি থাকতে যায়। মেয়েরা চাষবাস করে, তাঁত বোনে, দোকান চালান। মেয়েদের চালিত ‘ইমা’ বাজার দেখার স্থান। ২০১১ সালের গণনায় দেখা যাচ্ছে এখানে মেয়েরা ৭০ ভাগ শিক্ষিত, কাজে যুক্ত ৪৫%। সারা ভারতের এক্ষেত্রে যা গড় তা মণিপুরের (Manipur) চাইতে কম। এখানে সম্পত্তিও, বাবার দিকে আত্মীয় নয়, মায়ের দিকে আত্মীয়রা পেয়ে থাকে। মায়ের দিকের পুরুষ আত্মীয়রা সব নির্ধারণ করেন। (মনে মনে ভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে কী হবে?) এই রাজ্যেই মনোরমা মায়ের কথা আমরা ভুলে যেতে পারি না। থাংজাম মনোরমা। জঙ্গি বলে সেনাবহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। যখন তাঁর মৃতদেহটি উদ্ধার হয়, তখন দেখা ৬টি গুলি লেগে আছে। দু’টি স্তরে। ৪টি তলপেটে। ধর্ষণের চিহ্ন যাতে ধরা না পড়ে। সারা পৃথিবী নড়ে উঠেছিল। আমরা শিউরে উঠেছিলাম। ‘হাড় হিম করা’র কথা তো সামান্য এখানে মনোরমার জন্য ৪৬ থেকে ৫৬ বছরের আরও ১২ জন মা ‘ইমা’রা একেবারে নগ্ন দেহে সেনাবাহিনীর ছাউনির সামনে এসে বলেছিল, ‘এসো সেনাবাহিনী, আমাদের ধর্ষণ করো।’ সারা দেশ সেদিন মাথানত করে দাঁড়িয়েছিল মায়েদের সামনে। সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি নিয়ে সেদিন শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। মণিপুরের (Manipur) মেয়েরা এখনও নিয়মিত নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য সেনাবাহিনী যুক্ত এ-কথার যথেষ্ট সত্যতা আছে। এর বিরুদ্ধে ‘মাইরা পাইবি’ বলে এক মহিলা বাহিনী তৈরি হয়ে গিয়েছে। যার বাংলা অর্থ ‘মশালবাহী মহিলা’। মহাশ্বেতা দেবীকে হঠাৎ আজ মনে পড়ে। তাঁর ছোট গল্প ‘দ্রৌপদী’র জন্য। দোপদি মেঝেন-এর উপর রাষ্ট্রকর্তাদের অত্যাচার তিনি জানিয়েছিলেন আমাদের। সেই অত্যাচার আজও থামেনি। মণিপুরের (Manipur) পাহাড়ে কন্দরে, অরণ্যে আজও বহমান। কোথায় রাষ্ট্রপ্রধানরা? তাঁরা আজ লুকিয়েছেন। মনোরমা’র সন্তানদের সামনে মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই। দু’জন মহিলা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। লজ্জাহীন পুরুষরা মহিলা দু’জনের শরীর নিয়ে উল্লাস করছে। জোর করে তাদের পাশের খেতে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের কেমন নিগ্রহ করা হবে কুৎসিত অঙ্গ চালনাতেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। এই দু’জন মহিলা কুকি সম্প্রদায়ের। অত্যাচারী পুরুষরা মেইতেই এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর। তাহলে দেশের— এ-দেশের একটা রাজ্যে মেয়েরা কেমন করে বেঁচে আছে? এই ছবি সারা দেশ দেখেছে। বদলা শুরু হয়ে গেল মণিপুরে। গ্রাম, বাড়ি, থানা পোড়ানো শুরু হল। উৎখাত হতে শুরু হল কুকি-নাগা-জো গোষ্ঠীর মানুষরা। যেন গৃহযুদ্ধ চলছে। কেন্দ্রের সরকার ‘আমরা মণিপুরের পাশে আছি’ বলে নীরবতা পালন করছেন। এই আগুন সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মিজোরাম গিয়ে ৩০ হাজার কুকি-চিন-জা গোষ্ঠীর মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অন্যতম কারণ এই গোষ্ঠীর মানুষের অনেক আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আছে মিজোরামে। এখন দাবি উঠেছে মেইতেইদের সঙ্গে থাকলে কোনও সুবিচার আদিবাসীরা পাবে না। সুতরাং আদিবাসীদের আলাদা রাজ্যের দাবি।
আরও পড়ুন-মণিপুরের ঘটনায় ধিক্কার মিছিল মহিলা তৃণমূলের, জঙ্গিপুরে পথে নামল নারীশক্তি
পরিস্থিতিকে চমৎকার ঘোলা করে দিয়েছেন হেমন্ত বিশ্বকর্মা। যিনি ইতিমধ্যেই ‘ছোট অমিত শাহ’ হিসাবে পরিচিত লাভ করে ফেলেছেন। তাঁর চোখ দিয়েই উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে দেখছে বিজেপি সরকার। মণিপুরের বর্তমান অবস্থার জন্য তিনি পূর্বতন কংগ্রেস সরকারকে দায়ী করেছেন। ২০১০-২০১৭ সালের কংগ্রেস শাসনই নাকি সবকিছুর জন্য দায়ী। যে জাতি-সংঘর্ষ হচ্ছে তা নাকি পূর্বের রাজ্য গঠনের ভুল পরিকল্পনার ফসল। এটাই তাঁর মত। বিজেপি নতুন ইতিহাস লিখতে শুরু করেছে। এটা তারই এক খণ্ডচিত্র মাত্র।
সবাই জানেন মণিপুরের নাম মহাভারতে আছে। ভারতের সমাজদর্শন ও জনগোষ্ঠীর চিন্তার মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের স্থান অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাস না কল্পনা সেটার বিতর্কে যাচ্ছি না। অর্জুন বিয়ে করেছিলেন মণিপুরের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে। তাঁদের সন্তান বভ্রুবাহন। চিত্রাঙ্গদার বাবা চিত্রবাহন। তাঁর পুত্রসন্তান না থাকায় চিত্রাঙ্গদাকেই সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছিলেন। এমনকী যুদ্ধবিদ্যাতে। তৃতীয় পাণ্ডব তাতেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিবাহের পরে অর্জুন মণিপুর ত্যাগ করলেন। হাজারটা কাজে যুক্ত হয়ে পড়লেন। ভুলে গেলেন স্ত্রী-পুত্রদের কথা। সেকালে এমনটাই হত। এবার অশ্বমেধের ঘোড়া হস্তিনাপুর থেকে ছাড়া হয়েছে। সেটা মণিপুরে পৌঁছে সমস্যার মুখোমুখি। থামানো হয়েছে। যুদ্ধ শুরু। অর্জুনের লোকজনদের প্রবল পিটিয়েছে বভ্রুবাহনের বাহিনী। ভীম পরাজিত। বৃষকেতু জখম। অর্জুন হেরে প্রয়াত। পিতৃহত্যার দায়ে বভ্রুবাহন। সাংঘাতিক কেলেঙ্কারি। ইতিমধ্যে বভ্রুবাহন পিতৃপরিচয় পেয়ে আত্মহত্যায় উদ্ধত হয়। তা হবে না। কারণ সব কাজের কাজী শ্রীকৃষ্ণ আছেন— তাঁর স্মরণ নেওয়া হল। নাগামণি ঠেকিয়ে অর্জুনের দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি ‘চিত্রাঙ্গদা’র কাহিনি তা ধরেই। বাঙালির মনে গেঁথে আছে।
কিন্তু মণিপুরের আমার ‘মা’-এরা ‘নাগমণি’ চায়। মনোরমার দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। শত শত মা-বোন-ভাই-বন্ধু যাঁরা প্রাণ দিচ্ছেন তাঁদের দেহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব কে নেবে? আমরা বুঝে গেছি কেন্দ্রীয় সরকারের রকমসকম। প্রধানমন্ত্রী বিগত তিন মাসে প্রায় ১ ডজন বিদেশ ঘুরে ফেললেন। কিন্তু মণিপুরে গিয়ে ওই মানহারা মানবীর দ্বারে দাঁড়াতে পারলেন না। একবার তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না— যাঁদের হাত-পা বাঁধা আছে কড়া শৃঙ্খলে।
অনাস্থা প্রস্তাব এসেছিল এ-কারণেই। কিন্তু দীর্ঘ ভাষণ দিয়েও তিনি প্রথম দেড়ঘণ্টা মণিপুরের (Manipur) নামই আনেননি। কুৎসিত মনোভাবের প্রতি আমরা ধিক্কার জানাই। সারা দেশের বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়ে মণিপুরের পাশে আছেন। সারা ভারত মণিপুরের পাশে। আজ এমন দুর্বিপাকের সময় আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে। তার আহ্বান দিচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’। কবি জয় গোস্বামী ঠিকই লিখেছেন— তাঁদের কিন্তু ময়লা হাতের নোংরা স্পর্শে/ ঘেন্না জাগলে দেশের লোককে/ সে-কথা জানানো ঘোর অপরাধ! তাহলে কর্তাব্যক্তিরা আর/ কেউ থাকবে না তাঁদের পক্ষে/ কর্তাকে ঠিক নিরাপদ রাখে/ ক্ষমতায় থাকা সুরক্ষা-বাঁধ। (শেষ)