শিক্ষা হল আনন্দের ভোজ। তা কখনওই জীবনের সঙ্গে বিযুক্ত কোনও প্রক্রিয়া নয়। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার প্রতি পদক্ষেপেই শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়গুলি সংযুক্ত হতে থাকে। এটি একটি আমৃত্যু চলমান প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক, ডিগ্রি-সর্বস্ব শিক্ষাকেই শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক শিক্ষককেই শিক্ষক হিসেবে ধরে নিই। এই ধরে নেওয়ার নেপথ্যে অবশ্যই চাকরি, সামাজিক স্বীকৃতি ইত্যাদি বিষয়ের গুরুত্ব রয়েছে। সেগুলি অবহেলার নয়। কিন্তু এখানেই সবকিছু আটকে থাকলে একটা বড় ধরনের গন্ডগোল হয়ে যেতে পারে। সেটা একদিকে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারীকে সবজান্তা করে তোলে, অন্যদিকে তেমনি সমাজে শিক্ষার পরিসরটিও ছোট হয়ে আসে। তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকেরাও নতুন কিছু শিখতে বা বিশ্লেষণ করতে চান না। সবাই সব বুঝে গেছেন এমন মনোভাব তো আমরা অহরহ দেখতে পাই।
‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর/ সবার আমি ছাত্র’, লিখেছিলেন কবি সুনির্মল বসু। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গেই অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে জুড়ে দিতে হয়। এটা মার্কিন বা পশ্চিম ইউরোপীয় পুঁথিগত শিক্ষা এবং মূল্যায়নের মডেল ধার করে তার ভারতীয়করণ করে সম্ভব নয়। অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়েও দীর্ঘকালীন একটি প্রক্রিয়া যা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অনেকগুলি পথকে মুক্ত করতে হয় যাতে শিক্ষার্থীর কাছে একাধিক উপায় থাকে যেকোনও বয়সে শিক্ষালাভের (Teachers Day)। মানুষ মাত্রই আসলে শিক্ষার্থী। অভিজ্ঞতা থেকে যা শিখলাম তা পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে যাওয়াটাই শিক্ষার প্রায়োগিক দিক। কাল প্রবহমান। তা পিছন দিকে ধাবিত হয় না। সামনের দিকে এগিয়ে চলে। মানুষ যা করে, করে তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আজ আমরা কোনও ভুল করলে তার বোঝা চাপবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। শিক্ষা, যার অন্য নাম জীবনচর্যা, তা হেলাফেলার বস্তু নয়। একান্তভাবে এড়িয়ে বা অতি-তৎপরতার সঙ্গে আজ এই নীতি কাল অন্য নীতি নিয়ে চললে সমগ্র কাঠামোটাই বিপর্যস্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন- সংসদে বিশেষ অধিবেশন, রণকৌশল ঠিক করতে বৈঠক আজ
গান্ধীজি শিক্ষা নিয়ে, বিশেষত বুনিয়াদি শিক্ষা নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে হয়তো যথেষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সময় দিতে পারেননি সেগুলির প্রয়োগে। কিন্তু ইংরেজ সরকারের শিক্ষানীতি যে আমাদের পরাধীনতার একটি আবশ্যিক অঙ্গ, সেকথা বারবার বলেছেন। নিজের সন্তানদের এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর পুত্রদের কারও কারও মনে তাই নিয়ে অভিমান ছিল। কিন্তু সবার জন্য যা চাইছেন তাই নিজের সন্তানদের জন্য ধার্য করছেন, এমন সৎ সাহস সেসময়ে ছিল। তাই তাঁর ভাবনাকে আমরা গুরুত্ব দিতে পারি।
গান্ধীজির ভাবনায়, ‘‘In my opinion the existing system of education is defective, apart from its association with utterly unjust Government, in three most important matters:
1. It is based upon foreign culture to the almost exclusion of indigenous culture,
2. It ignores the culture of the heart and the hand, and confines itself simply to the head,
3. Real education is impossible through a foreign medium.”
এখানে তৃতীয় বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। বিদেশি ভাষায় শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না বলতে গান্ধীজি কিন্তু বিদেশি ভাষা-শিক্ষায় কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। বরং বলেছেন, ‘‘I regard English as the language of international commerce and diplomacy, and therefore consider its knowledge on the part of some of us as essential.”
ইংরেজি এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের মেলবন্ধনই তাঁর লক্ষ্য ছিল। প্রাচ্যকে পরিহার করে পাশ্চাত্য নয়। গান্ধীজির রাজনৈতিক জীবন রবীন্দ্রনাথের ছিল না। তিনি অনেক বেশি মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন শিক্ষা ভাবনার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগকে একত্রিত করতে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের জন্যই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা। বিরোধ নয়, মিলনই জীবনের লক্ষ্য। শিক্ষারও অভিপ্রায় এক হওয়া উচিত। একমাত্রিক সমাজ ‘তাসের দেশ’। কিন্তু আরোপিত বিরোধ বা শত্রুতা কাম্য হতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শুধু প্রকৃতির মাঝে পাঠের কথা বলে থেমে যাননি। প্রকৃতি মানে প্রতিষ্ঠানের বাইরের মানুষের কাছেও পৌঁছতে বলেছেন। এটাই ছিল শ্রীনিকেতনে তাঁর দরিদ্র পড়ুয়াদের জন্য ‘শিক্ষাসত্র’ প্রতিষ্ঠার ধারণা। সবাইকে নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা, যার অন্য নাম শিক্ষা। গ্রামীণ কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে বিশ্বভারতীর শিক্ষাকে (Teachers Day) জুড়তে চেয়েছিলেন তিনি। এখানে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী মিলে যান।
জীবনচর্যাই যদি শিক্ষা হয় তার মূল্যায়ন হবে কীভাবে? জীবন তার সব হিসেব বুঝে নেয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, বিশেষত শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের হৃদয়ের শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতর জানিয়েছে যে তারা স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন দিয়ে পড়ুয়ার মূল্যায়ন করবে। এই ভাবনাকে বাহবা দেওয়ার জন্য এই রাজ্যেও কিছু মহলে তৎপরতা খেয়াল করলাম। তাঁদের নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই যে শিশু বা কিশোর মন সবকিছু বিশ্লেষণ করে ফেলতে পারবে তো? আপনারা পারবেন তো? শোনা যায় বহুকাল আগে ম্যাট্রিকের গণিত পরীক্ষায় এমন নানা বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন করেছিলেন এক শিক্ষক (Teachers Day)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে সামনে বসে নির্দিষ্ট সময়ে সমাধান করতে বলেছিলেন। তিনি পারেননি।
কিছু বিশ্লেষণ করতে সময় লাগে। তার আগে, শিক্ষার প্রথম পর্বে প্রশ্ন তোলা এবং নিজস্ব মতামত দেওয়ার কাজটি পড়ুয়াকে দিয়ে করানো যায়। কিন্তু তাও ফরমুলা-মাফিক নয়। প্রতি দুদিন অন্তর মূল্যায়নের ব্যবস্থা করেও নয়। যথেষ্ট সময় দিয়ে, যত্নশীল হয়ে তবেই। সামাজিক নিরাপত্তা ও ভাবনার জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে, তবেই। সেই কাজটা কবে হবে?