মোদি জমানায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এ কথা বলছে ক্যাগ রিপোর্ট। তথ্য বলছে, বেকারত্ব এমন বেড়েছে যা গত পাঁচ দশকে দেখেনি ভারত। অভূতপূর্ব জাতি-বিদ্বেষে জ্বলছে মণিপুর। যা কমার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। তার পিছনে শাসক দল তথা তাদেরই সরকারের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ বেশ জোরালো। হরিয়ানা-সহ দেশের নানা জায়গা থেকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটে চলেছে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে।
আরও পড়ুন-এবার যন্ত্রাংশ কিনতেও ১১০ কোটি কৃষকদের
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই আচ্ছে দিনের ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এলেই নাকি আচ্ছে দিন এসে যাবে। ১০টা বছর কেটে গেল প্রায়। কিন্তু অবস্থা পাল্টাল না। এই সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে প্রকাশিত পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমি নিশ্চিত, ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় জায়গা করে নেবে ভারত। অর্থনীতি আরও বেশি আত্মনির্ভর ও উদ্ভাবনী হয়ে উঠবে। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী হবে মানুষ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা পরিষেবা মিলবে। অর্থাৎ আরও ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ এ-থেকে স্পষ্ট যে, মোদি ক্ষমতায় ফিরলেও ‘আচ্ছে দিন’ আসছে না। তিনি আরও বলেছেন, তখন দেশে দুর্নীতি, জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু থাকবে না। তাহলে তো মোদি মেনে নিচ্ছেন, এখন এই সব আছে বলে। বর্তমান সমস্যাদীর্ণ ভারতে সমস্যা সমাধানের কোনও পথ মোদির জানা নেই। তাহলে ২০২৪-এ তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার আশা করেন কেমন করে তিনি! তাঁর তো উচিত আর নির্বাচনে না দাঁড়িয়ে সন্ন্যাস নিয়ে বনবাসে চলে যাওয়া। বর্তমানে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও জাতি-দাঙ্গার মতো সমস্যায় ভুগছে দেশ।
আরও পড়ুন-কিংস কাপে ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচ, চেনা লেবানন, তবু আজ সতর্ক ভারত
এই অবস্থায় ২৫ বছর পরের কল্পনা করছেন মোদি। সত্যিই, কতটা দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় আছি আমরা। একেই বলে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি। এখন জি-২০ সম্মেলনের উপর ভর করে ‘বিশ্বগুরু’ সাজতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি! বর্তমান নিবন্ধে বেকার সমস্যা বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করা হবে।
বেকারত্বের সমস্যাটি যে কত গভীরে তা বোঝা যায় নির্বাচনের আগে ‘রোজগার মেলা’র আয়োজন দেখে। প্রতিশ্রুতিমতো নতুন কর্মসংস্থান নয়, খালিপদে কর্মী নিয়োগ করে মুখরক্ষার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলছে। বিভিন্ন অর্থশাস্ত্রীর হিসাব অনুসারে এই মুহূর্তে ভারতে দু’কোটি থেকে কুড়ি কোটি নতুন কাজ তৈরি হওয়া প্রয়োজন। রোজগার মেলায় দশ লক্ষ চাকরির লক্ষ্য, ভোটের বাজারে নরেন্দ্র মোদির কতটা সুবিধা হবে, সে-প্রশ্ন সরিয়ে রেখে— একথা বলাই যায়, এতে দেশের বিশেষ উপকার হবে না। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে শ্রীযুক্ত মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে দু কোটি নতুন কর্মসংস্থান হবে। তাহলে দশ বছরে অন্তত ২০ কোটি নতুন চাকরি হওয়ার কথা ছিল। প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। মোদি সে-কথা কিন্তু একবারও বলছেন না। সবকিছু হুড়িয়ে দেওয়াই তাঁর অভ্যাস।
আরও পড়ুন-নির্মাতা কেএমডিএ, পুজোর আগে ডাকা হবে দরপত্র, ৭০০ কোটি টাকায় শহরে নয়া উড়ালপুল
গবেষকরা হিসাব কষে দেখিয়েছেন, ২০১২ থেকে ২০১৮— এই ছ’বছরে ভারতে মোট কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ৯০ লক্ষ। স্বাধীন দেশের ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনা ঘটল। বোঝা যাচ্ছে, বেকারত্বের দায়টিকে অতিমারির ঘাড়ে চাপানোর উপায় নেই। সেই দায় সুস্পষ্টভাবেই সরকারের, মানে সরকারি নীতির। অতিমারি সংকটটিকে তীব্রতর করেছে। বেতনবৃদ্ধির গতি শ্লথ করেছে, কাজের বাজার থেকে মেয়েদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর বেড়েছে ‘স্ব-নিযুক্ত’ কর্মীর সংখ্যা। ভারতের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র-নির্ভর অর্থব্যবস্থায় এ-এক পরিচিত বিপদ বলেই মনে করা হয়। এ-কথাও আমরা জানি যে, ভারতে এখন কর্মক্ষম যুবক-যুবতীর সংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক। সেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নিয়ে মোদিবাবু পঞ্চমুখ। বেকারত্বের হারও তাঁদের মধ্যেই সর্বাধিক। প্রতি চার জনে এক জন। দশ লক্ষ সরকারি শূন্যপদ পূরণ করে কি এই সমস্যার সমাধান হয়?
আরও পড়ুন-তারাপীঠে হবে অত্যাধুনিক দমকল কেন্দ্র গাড়ি থাকবে সর্বক্ষণ, জানালেন মন্ত্রী
প্রশ্ন ওঠে, ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির ‘উজ্জ্বল’ হারের সঙ্গে বেকারত্বের এই ছবিটির এমন অস্বাভাবিক বৈপরীত্য কেন? এর কারণ, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি বহুলাংশে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুঁজি-নিবিড় পরিষেবা ক্ষেত্রের উপর। এর ফলস্বরূপ ভারতে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে, কাঠামোগতভাবেই তা সুষম হয়নি। চিন-সহ অন্য অনেক দেশেই (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছিল মূলত শিল্পক্ষেত্রের বিস্তারের পথে। সেই বৃদ্ধি শ্রমনিবিড়। ফলে সেখানে কর্মসংস্থান ঘটেছে। ঠিক এরই পাশাপাশি মোদি জমানায় শিল্পক্ষেত্রে গৃহীত দুটি বড় নীতি হল— ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেন্টিভ স্কিম’ যা পুঁজিনিবিড় শিল্পের উপর জোর দিয়েছে। ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার অছিলায় রফতানির বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। বেকারত্বের সমস্যা সেই ‘মহান’ ‘মহান’ সিদ্ধান্তগুলির মাশুল গুনছে। ছোট-বড় কোনও রোজগার মেলার সাধ্য নেই এই বিপদ থেকে ভারতকে রক্ষা করার। এই পথে চললে আজ যা হয়নি, ৪৭-শেও তা হবে না।
আরও পড়ুন-ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে সুনকের বার্তা খালিস্তানিদের
পথ বদলাতে হবে, মোদি-অনুসৃত অর্থনীতির পথ। অর্থনীতি একটি বিজ্ঞান। কোনও ম্যাজিক দিয়ে, কোনও হাতুড়ে অর্থনীতি দিয়ে, বিজ্ঞানকে প্রতিস্থাপিত করা যায় না।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তথা ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কাছে সবচেয়ে কঠিনতম প্রশ্ন হল, এই জোট জনসাধারণের সামনে বর্তমান শাসকের বিপরীতে কোনও বিকল্প পথ পেশ করতে চান। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সাংস্কৃতিক দিশা— সব দিক থেকেই সেই বিকল্প হাজির করতে হবে। নিজেদের আচার-আচরণে, কর্মসূচি রূপায়ণে সেই বিকল্প ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় শাসকরা যে জনবিরোধী নীতি ও আচরণের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন, বিরোধী দলগুলিকে আপন নীতি ও আচরণে তারই বিপরীতে জনমুখী নীতি ও আচরণের শর্তগুলি পালন ও পূরণ করতে হবে। জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার এটাই বহু পরীক্ষিত পথ। বলা বাহুল্য বিকল্প শক্তিকে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মর্যাদা দিয়েই সে-পথে এগোতে হবে।
আরও পড়ুন-জাল জাতিগত শংসাপত্র রুখতে আরও কঠোর প্রশাসন, শুধুমাত্র জেলাশাসকই দেবেন শংসাপত্র
বর্তমান নিবন্ধে ভয়াবহ বেকার সমস্যার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। এরপর রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতির দিকগুলি নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
লক্ষ্য করার বিষয় হল, শাসকের উদ্বেগ এবং অস্থিরতা এ-কথা প্রমাণ করেছে যে, ‘ইন্ডিয়া’ তার শুরুর কাজে সফল হয়েছে। শাসক ভয় পেতে শুরু করেছে।