একটি রাত
বিপ্লবী ভুবন মণ্ডল। চাষীদের নেতা। জোতদারদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। তাপ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে। চাষিরা জোট বাঁধেন। গর্জে ওঠেন সমবেতভাবে। ভুবনকে আদর্শ মানেন। প্রত্যেকেই বুঝে নিতে চান নিজেদের অধিকার। তাঁরা যে বঞ্চিত, শোষিত উপলব্ধি করেন। সমস্যায় পড়েন ধূর্ত জোতদাররা। বুঝতে পারেন, এবার চাষিদের ঠকানো প্রায় অসম্ভব। অসৎ উপায়ে পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করেন। ভুবন মণ্ডলের নামে বের হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভুবন ঘুরে বেড়ান এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। মিটিং করেন চাষিদের সঙ্গে। একদিন রাতে গ্রামে মিটিং সেরে হারান দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। জোতদারদের কারসাজিতে পুলিশের গুলিতে মৃত ছেলে সনাতনের শোকে অর্ধোন্মাদ হারান। পুত্রবধূ নিস্তারিণী, নাতি নিতাই ও নাতনি ময়নাকে নিয়ে তাঁর দরিদ্র চাষী পরিবার। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির মুখ দেখেনি ময়না। পণের দাবি মেটানো যায়নি বলে। ভুবন মণ্ডলের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ তাঁকে দেখেনি। হারানের ঘরে ভুবন রাত কাটাচ্ছেন, গোপনসূত্রে খবর যায় পুলিশের কাছে। দলবল নিয়ে ছুটে আসে খাকি উর্দিধারীরা। কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন ময়নার মা। উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। ভুবনকে নিজের জামাই পরিচয় দিয়ে মেয়ের সঙ্গে ঘরে ঢুকিয়ে দেন। হতচকিত হয়ে যায় পুলিশ। এইভাবে ময়নার মা গ্রেফতারির হাত থেকে বাঁচান চাষিদের নেতা ভুবন মণ্ডলকে।
আরও পড়ুন-ডিজিটাল দুনিয়ায় খবরদারি বাড়াতে বিল আনছে কেন্দ্র
তিন ভাগের দুই ভাগ
গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’। তেভাগা আন্দোলনের জটিল প্রেক্ষাপটে শোষিত, নির্যাতিত, সর্বহারা মানুষের চরম দুর্দশার কাহিনি নিয়ে লেখা। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল এই আন্দোলন। শামিল হয়েছিলেন ভাগ চাষিরা। তাঁদের প্রতিবাদ ছিল মূলত জমিদার, ধনী ব্যবসায়ী এবং দালালদের বিরুদ্ধে। ভাগচাষিদের জোরালো দাবি ছিল, উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দু’ভাগ তাঁদের দিতে হবে। সেই সঙ্গে দিতে হবে শ্রমের মর্যাদা। ছিল আরও কিছু দাবি। আন্দোলন চলাকালীন লিখিত হয়েছিল গল্পটি।
আরও পড়ুন-পকসো আইনে সম্মতির বয়স কমানোর বিরুদ্ধে আইন কমিশন
তেভাগা আন্দোলনের পঁচাত্তরে
বর্ষীয়ান নাট্যব্যক্তিত্ব অরুণ মুখোপাধ্যায় গল্পটি নিয়ে নাটক রচনা করেছেন কয়েক বছর আগেই। মঞ্চস্থ করেছে বিভিন্ন দল। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে এবং বর্তমান ভারতে ঘটে চলা কৃষক বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে নাটকটি মঞ্চস্থ করল ‘যাদবপুর রম্যানী’। অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়। মুকেশ চক্রবর্তীর ব্যবস্থাপনায়। গত রবিবার কলকাতার গিরিশ মঞ্চে ছিল প্রদর্শন। প্রেক্ষাগৃহ ছিল পূর্ণ। সাহিত্য থেকে নাট্যনির্মাণ— বিভিন্ন সময়ে করেছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। সমাদৃত হয়েছেন। এবারও মুগ্ধ করলেন দর্শকদের।
মূল সুর বিদ্রোহ
গল্পটি ছোট্ট। সেটা নিয়ে নির্মিত হয়েছে আড়াই ঘণ্টার পূর্ণাঙ্গ একটি নাটক। কাজটি খুব সহজ ছিল না। দৈর্ঘ্য বাড়াতে অতিরিক্ত কিছু মুহূর্ত সংযোজিত করা হয়েছে। বেড়েছে দৃশ্য। তাই কোনও কোনও সময় নাটক সরে গেছে মূল গল্প থেকে। গল্পের মূল সুর বিদ্রোহ। তার গনগনে আগুন নিভে গিয়ে কোথাও কোথাও মাথাচাড়া দিয়েছে মোটা দাগের হাস্যরস। ফলে কিছুটা হলেও ভাব তরল হয়েছে। আমূল পরিবর্তন এসেছে কিছু চরিত্রেও। তা সত্ত্বেও নাটকটি দর্শকদের টেনে রাখতে সক্ষম। কোনও সময় চোখ ফেরানো যায় না। প্রতিটি দৃশ্য টানটান। দৃশ্যান্তরের মুহূর্তে জন্ম নেয় কৌতূহল। কিছু কিছু সংলাপ মনে দাগ কেটে যায়।
আরও পড়ুন-৪০০ বছর ধরে নিষ্ঠায় পূজিত কাত্যায়নীরূপী দুর্গা
মঞ্চে এবং নেপথ্যে
জোতদার চণ্ডী ঘোষ চাষিদের ঠকানোর পাশাপাশি নানারকম অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। এই খলচরিত্রে নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেছেন মেঘনাদ ভট্টাচার্য। হাঁটাচলা, কথাবার্তায় তিনি অনবদ্য। পুলিশ মন্মথর চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করেছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। সাতকড়ির চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। মথুর চরিত্রে সৌমিত্র মিত্র মানানসই। ভুবন মণ্ডলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন চন্দন সেন। যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এ ছাড়াও হারান দাসের চরিত্রে দেবকুমার ভট্টাচার্য, শ্রীপতি চরিত্রে অমিত চক্রবর্তী, জগমোহন চরিত্রে শুভঙ্কর মুখার্জি, ময়না চরিত্রে আঁখি, হরিমতি চরিত্রে সুজাতা সরকার, চরণদাস চরিত্রে অভিজিৎ সরকার যথেষ্ট সাবলীল।
আরও পড়ুন-বিজেপি বিধায়ককে জেরা সিআইডির
বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় দেবলীনা চক্রবর্তীর নাম। ময়নার মা নিস্তারিণীর চরিত্রে তাঁর অভিনয় মন ছুঁয়ে গেছে। কখনও স্নেহশীলা জননী, কখনও ভেঙে পড়া অসহায় নারী, কখনও তেজস্বিনী, বুদ্ধিমতী, প্রতিবাদী— প্রতিটি সত্তা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। বাকিদের অভিনয়ও ঠিকঠাক। কোথাও ছন্দপতন ঘটেনি। আবহ রচনা করেছেন স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্চসজ্জায় মদন হালদার, আলোকসজ্জায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, পোশাক ভাবনায় সঙ্গীতা পাল, রূপসজ্জায় পঞ্চানন মান্না প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। নাটকে আছে বেশকিছু গান। শেষ দৃশ্যে চাষিদের কণ্ঠে গীত হয় সলিল চৌধুরীর ‘হেঁই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’। মঞ্চের পাশাপাশি ধীরে ধীরে গানের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র প্রেক্ষাগৃহে। চরিত্রদের পাশাপাশি দর্শকদের মুখে মুখেও। বুকে জ্বলে ওঠে আগুন। ‘জান কবুল আর মান কবুল’ করেন সবাই। দেওয়ালে পিঠ। চাষীদের সমস্যা যেন নিজেদের সমস্যা। চাষীদের গান হয়ে ওঠে সবার গান। দেশ জুড়ে চলছে কৃষকদের উপর বঞ্চনা। গানটির মধ্যে দিয়ে জোরালো প্রতিবাদ রচিত হয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। এইভাবেই দেশের কৃষক বিপ্লবের প্রতি সমর্থন এঁকে উদ্যাপিত হয় তেভাগা-র পঁচাত্তর।