সম্প্রতি ফিজিওলজি অর মেডিসিনে নোবেল পেলেন দুই বিজ্ঞানী ক্যাটালিন কারিকো এবং ড্রিউ ওয়েইসম্যান। স্টকহোমের করোলিনস্কা ইন্সটিটিউটে নোবেল কমিটি নাম ঘোষণা করলেন। কোভিড ১৯-কে প্রতিহত করার ভ্যাকসিন তৈরিতে এঁদের অবদানের জন্যই এই স্বীকৃতি পেলেন তাঁরা। দীর্ঘদিন ধরেই মানবদেহের mRNA নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন ক্যাটালিন ও উইসম্যান। mRNA কীভাবে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, সেটাই তাঁদের মৌলিক গবেষণায় তুলে ধরেছেন এই দুই বিজ্ঞানী, যা কোভিড ভ্যাকসিন তৈরিতে সাহায্য করেছে। হাঙ্গেরির ক্যাটালিন কারিকো হলেন একজন জৈব রসায়নবিদ, যিনি ১৯৯০-র গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপিকা ছিলেন। পড়ানোর পাশাপাশি mRNA নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ক্যাটালিন। এরপর পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাটালিন-এর সঙ্গে পরিচয় হয় উইসম্যানের। এই উইসম্যানের ডেনড্রাইটিক কোষ নিয়ে ছিল দারুণ আগ্রহ। ২০০৫-এ তাঁদের মৌলিক গবেষণা প্রকাশিত হয়। কোভিড অতিমারি শুরুর অন্তত ১৫ বছর আগে। ২০২০-তে অতিমারি শুরু হলে ভ্যাকসিন তৈরি যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, তখনই কাজে আসে এই দুজনের গবেষণা।
আরও পড়ুন-আহা! কী হবে এবার?
অতিমারির আগে ভ্যাকসিন
সাম্প্রতিক দশকগুলিতে আণবিক জীববিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা দরকার কারণ, এর ওপর ভিত্তি করেই এখন সম্পূর্ণ ভাইরাসের পরিবর্তে পৃথক ভাইরাল উপাদানগুলিকে নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে। ভাইরাসের জেনেটিক কোডের অংশগুলি সাধারণত ভাইরাসের বাইরের আবরণীতে পাওয়া এনকোডিং প্রোটিন তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। যা ভাইরাস-অবরোধকারী অ্যান্টিবডিগুলিকে উদ্দীপিত করে। এর সবচাইতে ভাল উদাহরণ হল হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা ভ্যাকসিন। এর পাশাপাশি আবার বিকল্পভাবে, ক্ষতিকারক ভাইরাসের জিনের অংশগুলি ক্ষতিকারক নয় এমন ভাইরাসে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে যা ভেক্টর হিসেবে কাজ করার দ্বারা দেহে ওই ক্ষতিকারক ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এই পদ্ধতিটি সাধারণত ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুন-দলিত ছাত্রের হয়ে বিদ্বজ্জনদের চিঠি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে
সম্পূর্ণ ভাইরাস বা তার প্রোটিন এবং ভেক্টর-ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দীর্ঘ সময়ের কোষ কর্ষণ তথা সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ে যা মহামারীর সময় দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদনের সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেয়। তাই, গবেষকরা দীর্ঘকাল ধরেই এই কোষ কর্ষণকে ব্যতিরেকে স্বাধীন ভ্যাকসিন প্রস্তুতির জন্য চেষ্টা করে চলেছেন।
mRNA-ভ্যাকসিন, এক নতুন দিশা আমাদের কোষে, DNA-তে থাকা বা এনকোড করা জেনেটিক তথ্য মেসেঞ্জার RNA (mRNA)-তে স্থানান্তরিত হয়, যা প্রোটিন উৎপাদনের টেমপ্লেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলস্বরূপ DNA-তে থাকা তথ্য অনুযায়ী আমরা প্রোটিন পাই। তাই যদি কোনওভাবে এই mRNA-কে পরিবর্তন করা যায় তাহলে আমরা ইচ্ছা অনুযায়ী প্রোটিন পেতে পারব। এই ধারণাটিকে সঙ্গে নিয়েই ১৯৮০-র দশকে, কোষ কর্ষণ ছাড়াই mRNA উৎপাদনের জন্য চালু হয়, ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপশন নামক এক কার্যকর পদ্ধতি। পরবর্তীকালে এই পদক্ষেপটিই বিভিন্ন ক্ষেত্রে আণবিক জীববিজ্ঞানের প্রয়োগকে আরও সম্প্রসারিত করেছিল, দিয়েছিল অন্য মাত্রা। কিন্তু এতে বাধা ছিল প্রচুর। ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রাইবড mRNA ছিল অস্থায়ী প্রকৃতির এবং একে সরবরাহ করাও ছিল যথেষ্ট মুশকিলের কাজ। mRNA-কে পরিবৃত করার জন্য প্রয়োজন ছিল অত্যাধুনিক লিপিড সিস্টেমের যার গোদা বাংলা হল লিপিডের থলির মধ্যে mRNA-কে পুরে প্রয়োজনীয় কোষে পাঠানো। কিন্তু আবারও সমস্যা দেখা যায়, এইভাবে উৎপাদিত mRNA দেহে প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে থাকে। তাই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে mRNA-এর এই প্রযুক্তিগত প্রয়োগকে প্রাথমিকভাবে সীমিত করা হয়।
আরও পড়ুন-৩০ জুনের মধ্যেই বঞ্চিতদের বকেয়া অঙ্গীকার অভিষেকের, আজ বাটা স্টেডিয়ামে খেলবেন রোনাল্ডিনহো
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে হাঙ্গেরিয়ান জৈব রসায়নবিদ ক্যাটালিন কারিকো এই গবেষণা চালানোর জন্য অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হন, কিন্তু তা সত্ত্বেও mRNA-থেরাপি ও তার গুরুত্ব সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি একটুর জন্যও পাল্টাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কারিকোর সহকর্মী ছিলেন ইমিউনোলজিস্ট ড্রিউ ওয়েইসম্যান। তিনি ডেনড্রাইটিক কোষগুলির প্রতি আগ্রহী ছিলেন, যেগুলি সাধারণত অনাক্রম্যতার প্রয়োজনে ন্যস্ত নজরদারিতে এবং ভ্যাকসিন-প্ররোচিত প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনাক্রম্যতন্ত্রকে সক্রিয় করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নতুন ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ, উভয়ই এরপর একযোগে বিভিন্ন RNA প্রকারগুলি কীভাবে অনাক্রম্যতন্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার ওপর নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু করে।
আরও পড়ুন-সমালোচকদের কণ্ঠরোধ লক্ষ্য, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ নিয়েও এবার আইন করতে চায় মোদি সরকার
যুগান্তকারী আবিষ্কার
কারিকো এবং ওয়েইসম্যান উভয়ই লক্ষ্য করেন যে ডেনড্রাইটিক কোষগুলি ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপ্টড mRNA একটি বাইরের পদার্থ হিসেবে দেখে, ফলে তারা দেহের অনাক্রম্যতন্ত্রকে সেই নির্দেশই পাঠায়, তাই তার থেকে প্রতিরক্ষার জন্যই অনাক্রম্যতন্ত্র বিভিন্ন প্রদাহ সৃষ্টিকারী রয়াসায়নিক পদার্থ রক্তে ক্ষরণ করতে থাকে। এই অবস্থা কারিকো এবং ওয়েইসম্যান উভয়কেই বিস্মিত করেছিল যে কেন ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রাইবড mRNA ডেনড্রাইটি কোষের কাছে বাইরের পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল, যেখানে কিনা স্বাভাবিকভাবে কোষ থেকে পাওয়া mRNA কিন্তু এরকম কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এইসব দেখে তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য অবশ্যই আছে যা কিনা বিভিন্ন ধরনের mRNA-কে আলাদা করছে। RNA-তে চারটি বেস রয়েছে কারিকো এবং ওয়েইসম্যান উভয়ই জানতেন যে-কোনও স্তন্যপায়ীর কোষে RNA-তে থাকা বেসগুলি ঘন ঘন রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যেখানে ইন ভিট্রো উপায়ে ট্রান্সক্রিপ্ট করা mRNA তা করতে পারে না। তারা ভাবতে থাকে যে ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিবড RNA-তে থাকা বেসসজ্জাই ডেনড্রাইট কোষকে প্রদাহজনিক রাসায়নিক ক্ষরণ করতে উদ্দীপিত করে। তাই তারা এর অনুসন্ধান করতে mRNA-এর বেস সজ্জার পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন প্রকার mRNA তৈরি করে ডেনড্রাইটিক কোষগুলির সামনে হাজির করতে থাকে এবং এক আকর্ষণীয় ফলাফলের সম্মুখীন হন। তাঁরা দেখেন পরিবর্তিত mRNA-গুলি কোনওরকম প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেনি।
আরও পড়ুন-উইকএন্ডেই সারা ফিলাডেলফিয়ার দুর্গাপুজো
২০০৮ এবং ২০১০ সালে প্রকাশিত আরও গবেষণায়, কারিকো এবং ওয়েইসম্যান দেখিয়েছিলেন যে বেস পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন mRNA-এর প্রোটিন উৎপাদনের ক্ষমতাও বেশ বেশি। প্রোটিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে এমন উৎসেচকের সক্রিয়তা, উৎপন্ন mRNA-তে হ্রাস পাওয়াই হল এর মূল কারণ। বলাবাহুল্য তাঁদের আবিষ্কারের মাধ্যমে উৎপন্ন পরিবর্তিত mRNA-ই কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই mRNA-গুলির প্রয়োগের পথকে সুগম করেছিল।
COVID-19 অতিমারির প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে, বেস সংশোধনের দ্বারা দ্রুত হারে SARS-CoV-2 পৃষ্ঠ প্রোটিন এনকোডিং mRNA ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছিল। এর প্রয়োগে প্রায় ৯৫%-এর প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব রিপোর্ট করা হয়েছিল। এই mRNA ভ্যাকসিনগুলি কিন্তু করোনার হাত থেকে লক্ষাধিক জীবন বাঁচিয়েছে, সমাজকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে।