সৌম্য সিংহ: বিষাদের অশ্রুধারায় আনন্দের রশ্মিরেখা। বছরভর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার পরে মা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটানো মানে সব দুঃখ-গ্লানি ভুলে আনন্দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া। তাই দশমীতে উমার বিদায়বেলায় হৃদয়ে বিষাদের সুর তো বাজবেই! তবু এই বিজয়াকে কেন্দ্র করেই খুলে যায় অনেক রুদ্ধদ্বার। শুধুমাত্র একটু শুভেচ্ছা, শুভকামনা আর আন্তরিকতায় ভরা হাসি— এনে দেয় শত্রুকে মিত্র, পরকে আপন করে নেওয়ার অনন্য সুযোগ। মুছে দেয় মনের দূরত্ব, খুলে দেয় সম্পর্কের রুদ্ধদ্বার। এখানেই বিজয়ার তাৎপর্য, পবিত্রতা এবং নির্মল আনন্দ।
আরও পড়ুন-পুজো শেষে কলকাতা পুলিশ ও পুর আধিকারিকদের প্রশংসায় ভরালেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম
বিজয়া কিংবা দশেরা— উৎসবের তাৎপর্য এক-এক জায়গায় এক-একরকম। পূর্ব, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ এবং উত্তর ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলের মানুষ এদিন মহামায়ার হাতে মহিষাসুর নিধনের আনন্দে মেতে ওঠেন। আবার উত্তর, মধ্য এবং পশ্চিম ভারতের বেশিরভাগ মানুষ রামচন্দ্রের হাতে রাবণবধের আনন্দে মেতে ওঠেন এদিন। পালন করেন দশেরা। দাহ করা হয় রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং মেঘনাদের কুশপুতুল। তবে বঙ্গসংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ এই বিজয়া দশমীই। বাঙালির আইকন মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর ভবানীপুরের বাড়ির দরজা সকলের জন্য খুলে রাখতেন বিজয়ার সন্ধ্যায়। কোঁচানো ধুতি আর গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে আপ্যায়ন করতেন সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ— সকলকেই। নিজের হাতে এগিয়ে দিতেন কুঁচোগজা, নিমকি, মিহিদানা, সীতাভোগ এবং মিষ্টি সাজানো প্লেট। সঙ্গে অবশ্যই ঘুগনি। সবই বিশেষ কারিগর দিয়ে তিনি তৈরি করাতেন নিজের বাড়িতেই। সময় বদলেছে। কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোতে বিজয়ার সেই রমরমা আর নেই বললেই চলে। তবুও মঙ্গলবার ভোর থেকেই মিষ্টির দোকানে মিহিদানা, খাস্তাগজার চাহিদা মনে করিয়ে দিচ্ছে বাঙালির বহমান ঐতিহ্যের কথা। কোলাকুলির সেই দিন হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, তবুও ই-গ্রিটিংসে সম্পর্ক নবীকরণের আন্তরিক প্রচেষ্টা।
আরও পড়ুন-পুতিন গুরুতর অসুস্থ? মিডিয়ার খবরে জল্পনা
সোমবার রাত ৯টা ২৭ মিনিটের পরেই অবসান হয়েছে নবমী নিশির। কিন্তু উৎসবের শেষ প্রহরকে হৃদয় দিয়ে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছেন সব বয়সের মানুষ। মঙ্গলবার সকালবেলার আলোয় যেন বেজে উঠেছে বিদায়ব্যথার ভৈরবী। ভবানীপুর, লেক মার্কেট এলাকায় বনেদিপাড়ার কয়েকটি বারোয়ারিতে বেলা ১১টার পরেই শুরু হয়ে যায় বরণ এবং মেয়েদের সিঁদুরখেলা। উত্তর কলকাতার বেশ কিছু বাড়ি এবং পাড়ার পুজোতেও একই ছবি। বিদায়বেলায় কোথাও কোথাও বিশেষ রীতি। ক্যানিং-এর ভট্টাচার্যবাড়িতে মাকে রওনা করানোর আগে খাওয়ানো হল পান্তাভাত এবং কচুশাক। আবার টাকি রাজবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের পরেই এলাকার অন্যান্য প্রতিমা বিসর্জনের রীতি। তারপরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ইছামতীর বুকে দুই বাংলার মিলনমেলা। সবমিলিয়ে কলকাতা-হাওড়া যমজনগরীতে সকাল সকাল গঙ্গায় নিরঞ্জনের পথে মা দুর্গা। বাবুঘাট, বাজাকদমতলা, বিচালিঘাট, নিমতলা, আহিরিটোলায় কড়া পুলিশি সতর্কতা। প্রস্তুত পুরসভার কর্মীরা এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। পশ্চিমপাড়ের হাওড়াতেও একই আয়োজন।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশের এই পুজোয় উঠে এল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবি, এক উঠোনেই মসজিদ ও মন্দির
তবে দশমী মানেই কিন্তু দুর্গাপুজোর ইতি নয়। কথিত আছে, কৈলাসে ফেরার পথে উত্তরের জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়িতে কৃষকরা চিনে ফেলেন মাকে। সেখানে একদিন থেকে গিয়ে গ্রামবাসীদের হাতে পুজো নেওয়ার আবদার করেন তাঁরা। রাজিও হন উমা। সেই থেকে আজও একাদশীর দিন বার্নিস এলাকায় দেবীদুর্গাকে পুজো করা হয় ‘ভাণ্ডানী’ নামে। মহা ধুমধামে।