এই যে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিজেপি (BJP) সাংসদ তথা অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি বিনোদ সোনকার-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে গেছে অনৈতিক, ব্যক্তিগত, অশালীন প্রশ্ন করবার, যার প্রতিবাদে মহুয়া মৈত্র-সহ সব বিরোধী সদস্য ওই কমিটির শুনানি চলাকালীন সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, যে-প্রশ্নের বহর দেখে স্বাভাবিক বুদ্ধির মানুষ ক্ষুব্ধ, যে-প্রশ্ন প্রসঙ্গে ক্রুদ্ধ বিরোধী নেতা দানিশ আলি বলেছেন, খোদ নীতি কমিটির প্রধানই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছেন, সেই দুঃশাসনীয় কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
গত মে ২০২৩-এ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ন’বছর পূর্তি হল। ঘটা করে নতুন সংসদ ভবনের উন্মোচন। এরই পাশাপাশি, আমরা দেখলাম দিল্লির পথে এক নির্বাচিত বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন-নিপীড়নের অভিযোগ এনে মহিলা কুস্তিগিরদের মিছিল, যাদের দমন করতে নির্মম ভাবে লাঠিপেটা করল মোদি-শাহর এই দুই ইঞ্জিন সরকারের পুলিশ। অবশ্য এই অশালীন বলপ্রয়োগ কি আমরা আগে দেখিনি এই হাল্লা রাজার তাসের দেশে?
সেই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস আন্দোলনের সময় শীতের বিকেলে দক্ষিণ দিল্লির শাহিনবাগে মহিলাদের ওপর যা চলেছিল, তা কি সম্মানজনক ঘটনা? অথবা দানবিক কৃষি-আইনের প্রতিবাদে সত্যাগ্রহীদের লং মার্চের সময় কৃষক রমণীদের যেভাবে হেনস্থা করেছিল এই বিজেপি, তাও তো ভোলার নয়।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসবার সময় বিজেপি (BJP) যে ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল, তাতে নারীশক্তির ক্ষমতায়নের কথা বলা আছে। সমানাধিকার নয় ‘ক্ষমতায়ন’! ভারতের মাতা, ভগিনীরা বিজেপি’র পুরুষেরা ঠিক করে দেবে তোমাদের ক্ষমতার দৌড় কতটা।
কালে কালে আমরা দেখলাম যে বিজেপি তাদের ২০১৪-এর নির্বাচনী ইস্তাহারে বলেছিল, ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ)-এর শাসনে নারীদের ওপর অত্যাচার সহ্যের সীমার বাইরে চলে গিয়েছে, তাদের আমলেই মহিলাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের নতুন রেকর্ড!
জাতীয় তথ্য-প্রকাশকারী সংস্থাগুলির স্বাধীনতায় বেআব্রু হস্তক্ষেপের পরেও ন্যাশনাল ক্রাইমস রেকর্ড ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে যেখানে মহিলাদের উপর সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ২.৪৪ লক্ষ, ২০২১ সালে, বিজেপি জমানায় তা দাঁড়িয়েছে ৪.২৮ লক্ষ— প্রায় ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি!
বস্তুত, এখন নারীদের উপর সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা পূর্বের সব তথ্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে, পাশাপাশি অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়ার সংখ্যাও পূর্বের সব সংখ্যার থেকে কম!
এ ঘটনা চলছেই। অখ্যাত, নির্জন উন্নাও-এর কথা মনে পড়ছে? যে জনপদ বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেনগার, মানে সেই ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি জনপ্রতিনিধির দৌলতে ‘জাতীয় খবর’ হয়ে উঠেছিল? কিংবা দেশের তেরঙা পতাকা আন্দোলিত করতে করতে জম্মু কাশ্মীর রাজ্যে বিজেপি মন্ত্রীদের মিছিল? কাদের জন্য এই মিছিল? কাঠুয়া-র নিরপরাধ বালিকাটিকে ধর্ষণ করে হত্যায় অভিযুক্ত যারা, তাদের সমর্থনে!
এই বিজেপি-ই যে শবরীমালা মন্দিরে হিন্দু মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধকরণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তাও কি আমরা ভুলে গেছি? নারীদের ওপর হিংসা দমন করতে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী খুব ঘটা করে যে ‘রোমিও স্কোয়াড’ বানালেন, তার প্রধান কর্ম যে এখন সেইসব যুগলকে দমন করা, যারা জাতপাত-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে বিবাহিত জীবন যাপন করতে চান, সে কথাও আজ আর কারও অজানা নয়।
বিজেপি-র (BJP) কাছে নারী হল সন্তান প্রসবের যন্ত্র মাত্র! ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে সাধ্বী প্রাচী এমন বারোজন হিন্দু পুরুষকে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিল, যাদের সন্তান সংখ্যা চার বা তার অধিক। এদের একজন দ্বারিকা সিং, যার ১১টি সন্তান, আর দু’জন রামপাল সিং এবং সুরনাম সিং, যাদের প্রত্যেকের ৯টি করে সন্তান। খুব ভাল কথা। কিন্তু এই ‘আনন্দযজ্ঞে’, যারা ওই বাচ্চা উৎপাদনকারী যন্ত্র, সেইসব মহিলারা অনুপস্থিত! তাদের আমন্ত্রণ জানানোই হয়নি। এই দর্শন প্রতিফলিত বিজেপি’র নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যেও। ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি’র কথা বলা হলেও, ‘ইকুয়াল অপোরচুনিটি ফর উইমেন’ বলা হলেও বিজেপি-তে নির্বাচিত মহিলা সাংসদের সংখ্যা খুবই কম।
প্রধানমন্ত্রীর উজ্জ্বলা যোজনা প্রকল্প, যা ‘পিছিয়ে পড়াদের জন্য’ সস্তায় গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়ার ঘোষণা করেছিল, তার ছবি দেখলে অধিকাংশ মানুষের মনে হবে নারী রান্নাঘরের রুটি বানাবার মেশিন!
নারী নরকের দ্বার। বিজেপি’র এক নম্বর নেতা থেকে ন’শো নিরানব্বই নম্বর নেতা, নিজেদের জন্মতথ্য ভুলে গিয়ে, নিজেদের সন্তান-সন্ততির সূত্র ভুলে গিয়ে, এই বাক্যটিতেই অবিচল থেকে ধারাবাহিকভাবে মা-বোনেদের অপমান করে চলেছেন।
আড়েবহরে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যানকে তাই এখন আর সদর্থে অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি বলা যাবে কি না জানি না, তবে তিনি যে অনগ্রসর চেতনার বিশ্বস্ত প্রতিনিধি, এ নিশ্চিত।
নারীবিদ্বেষী বিজেপি সরকার, আগেও প্রমাণিত, এবারও ফের
এথিক্স কমিটিতে আন এথিক্যাল মন্তব্য। এটাই ভারতের জঞ্জাল পার্টির সংস্কৃতি। এবারই প্রথম নয়। আগেও মহিলাদের প্রতি অপমানজনক মন্তব্য করতে এরা ইতস্তত করেনি। এদের লজ্জাও নেই, শিষ্টাচারের বালাইও নেই। লিখছেন তানিয়া রায়