এসব হচ্ছেটা কী? বিধানসভা কি মল্লযুদ্ধের স্থান বা রাজনৈতিক স্লোগানের জায়গা? বিধানসভার বাইরে থেকে একদল মাননীয়/মাননীয়া বিধায়ক হঠাৎ বিধানসভার চত্বরে প্রবেশ করে স্লোগান দিতে শুরু করলেন এবং অকথা-কুকথার বন্যা বইতে লাগল। আমাদের রাজ্যের বিধানসভায় গত ৫০ বছরে এই ধরনের ঘটনা/দুর্ঘটনা দেখা যায়নি। ৭০-এর দশক থেকে আমার বিধানসভায় যাতায়াত। প্রথমে পিএইচডি সম্পর্কিত গবেষণার কাজে বিধানসভার গ্রন্থাগারে প্রায়ই যেতাম। দেখতাম কয়েকজন বিধায়ক লেখাপড়া করছেন, অবশ্য তাঁদের সংখ্যা কম ছিল।
আরও পড়ুন-এনিমিজ ইন মাই লাইফ
১৯৮২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিধানসভার অতি-বিশিষ্ট বিরোধী নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংসদীয় বিষয়ে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের প্রায় সমস্ত বরিষ্ঠ নেতা এটা জানেন। সুব্রতদার সঙ্গে মাঝে মাঝে বিধানসভায় যেতাম। একতলায় ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে সভার কার্যাবলী মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতাম। আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, বাদানুবাদ হত। রঙ্গ-তামাশাও হত। স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধীরা সভাকক্ষ ত্যাগ করতেন এবং লবিতে কিছু সময় স্লোগান দিতেন। সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের ক্ষোভ ব্যক্ত করতেন। এই পর্যন্তই। কিন্তু অকস্মাৎ দলবদ্ধভাবে কদর্য ভাষায় স্লোগান গত কয়েক দশকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিধানসভা ও সংসদ ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্দির। বিরোধী সদস্যরা তথ্য-যুক্তি-সহ সরকারের সমালোচনা করবেন, প্রশাসনিক ভুল-ত্রুটিগুলি দেখিয়ে দেবেন, এটা যে কোনও সুস্থ মানসিকতার নাগরিক প্রত্যাশা করবেন।
আরও পড়ুন-বাংলার ঝুলিতে বাঙালির ভাটনগর
সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব আইনসভার (নিম্নকক্ষের) সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থার উপর নির্ভরশীল। মন্ত্রিসভা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে। অবশ্য শাসকদলের ভাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সেটি সম্ভব নয়। অবশ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবার একাধিক সংসদীয় পদ্ধতি রয়েছে। সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল প্রশ্ন। প্রশ্ন করবার কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। এই প্রশ্নের মাধ্যমে জাতীয় স্তরে অনেক কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে। আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে— যেমন দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব, উল্লেখ পর্ব, আধ ঘণ্টা আলোচনা, দীর্ঘ আলোচনার প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব ইত্যাদি। এ ছাড়া বাজেট অধিবেশনে প্রতিটি প্রশাসনিক দফতরের ব্যয়বরাদ্দ নিয়ে আলোচনার সময় সরকারি বিভাগগুলির কাজের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরবার এবং গঠনমূলক প্রস্তাব দেবার পর্যাপ্ত অবকাশ রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত অনুশীলন। সেটা হচ্ছে কি? প্রায় প্রতিদিন অধিবেশনের সময় সভাকক্ষে হল্লা, চিৎকার, কুভাষার প্রয়োগ, এমনকী ধ্বস্তাধ্বস্তি হচ্ছে। এই কাজ বা কুকাজের জন্য কি আমরা সাধারণ মানুষ প্রতিনিধি নির্বাচন করেছি? বিধানসভা, সংসদ চালানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ফলাফল কী হচ্ছে? উত্তরোত্তর এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম রাজনীতি ও সর্বস্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি শ্রদ্ধা হারাচ্ছেন। মাননীয়/মাননীয়া বিধায়করা কি এই সম্বন্ধে সচেতন? কবে চেতনা ফিরবে?
আরও পড়ুন-শিশু নক্ষত্রের ভিড়ে
আদর্শ সংসদীয় রাজনীতি সম্পর্কে দু-একটি তথ্য দিচ্ছি। বিশিষ্ট সাংসদ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘Indian Parliament’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৫২ সালে তিনি যখন প্রথম লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন তাঁকে ‘প্রশ্ন’ করবার নিয়মকানুন হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। অথচ তিনি ছিলেন কমিউনিস্টদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শত্রু। পরম যত্ন ও স্নেহের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ সংসদের নিয়মকানুন শিখিয়েছিলেন। হীরেনবাবু আরও লিখেছেন, ১৯৫৭ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর এক যুবক লোকসভার সদস্য হলেন। হিন্দি ভাষায় অত্যন্ত সুবক্তা। সরকারকে তথ্য-যুক্তি ও ভাষার চাতুর্য দিয়ে তীব্র সমালোচনা করতেন। একই সঙ্গে প্রতিটি শব্দ চয়ন সুচিন্তিত, ভাষা সংযত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রসবোধ। ব্যক্তিগতভাবে ভদ্র ও রুচিসম্পন্ন। প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু যুবকটিকে স্নেহ করতেন। তাঁর নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী। তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। এটা বাস্তব সত্য, লোকসভায় পণ্ডিত নেহরু ও শ্যামাপ্রসাদের বাক্যবিনিময়, বাদানুবাদ ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে এক গৌরবময় অধ্যায়। লোকসভার সংশ্লিষ্ট কার্যবিবরণী আমি কিছুটা পড়েছি। প্রতিটি বিধায়ক ও সাংসদের পাঠ করা উচিত। সংসদে কখনও কখনও রঙ্গ-রসিকতা হত। সংবাদপত্রে পড়েছি, একদিন লোকসভায় বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক নেতা ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ডক্টর রামমনোহর লোহিয়া মহিলাদের সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন। এই সময় কংগ্রেস সাংসদ তারকেশ্বরী সিনহা বলে উঠলেন, ‘আপনি মহিলাদের সমস্যা কীভাবে বুঝবেন? বিয়ে তো করলেন না!’
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের সামনে ভাটিকা, আই লিগে আজ অভিযান শুরু কিবুর দলের
ডক্টর লোহিয়া বক্তব্য থামিয়ে তারকেশ্বরীদেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা করতে করতে আমার আর বিয়ে করা হল না!’ লোকসভায় হাসির রোল উঠল। সুব্রত মুখোপাধ্যায় যখন প্রথম বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন, তিনি এসইউসিআই-এর প্রধান বিধায়ক ও বিধানসভার নিয়মাবলি সম্পর্কে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রদ্ধেয় সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরােধ করেছিলেন, তাঁকে নিয়মকানুন শিখিয়ে দিতে। সুবোধবাবু অস্বীকার করলেন। সুব্রতদা কারণ জানতে চাইলেন। বললেন, তিনি কংগ্রেসের লোক বলেই কি সুবোধবাবু সাহায্য করবেন না? সুবোধবাবু বললেন, তিনি দেখতে চান সুব্রতবাবু শিক্ষার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক। সুব্রতদা জানতে চাইলেন, কী প্রমাণ দিতে হবে? সুবোধবাবু বললেন, প্রতিদিন বিধানসভায় সংসদীয় রীতিনীতি সংক্রান্ত কয়েকটি বই নিতে প্রবেশ করতে হবে। তন্মধ্যে অবশ্যই Erskine May রচিত ‘Parliamentary Practice’ (সম্ভবত এটাই বইটির নাম)। পড়ুক বা না-পড়ুক, বইগুলি হাতের সামনে রেখে বসে থাকতে হবে। কয়েকদিন এই অভ্যাস করলে, তবেই তিনি শিক্ষা দেবেন। সুব্রতদা এবং সুবোধবাবু দু’জনেই তাঁদের কথা রেখেছিলেন। এই বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতামূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ঐতিহ্য কি ফিরিয়ে আনা যায় না।