দেবাশিস পাঠক : “ _একটি মৃত্যু কিংবা খুন“_ `_
স্টান স্বামী মারা যাননি। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভারতবর্ষ একটা বিশাল জনবহুল দেশ। জন বিস্ফোরণ এদেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে। সেখানে এক জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু, বিশেষত সেই মানুষটি যখন অশীতিপর, তখন তা পৃথক তাৎপর্যে উচ্চারিত হওয়ার দাবি করতে পারে না। পারাটা উচিত নয়। কিন্তু স্টান স্বামীর মৃত্যু সে দাবি তুলছে। তুলছে কারণ, স্টান স্বামীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েও পুলিশ এমন কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি যার দ্বারা নিশ্চিত ভেবে বলা যায় ওই জেসুইট ধর্ম যাজক রাষ্ট্রদ্রোহী ছিলেন। বরং সবাই জানত, আজও মানে, স্টান স্বামী আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকারের দাবি নিয়ে ঝাড়খন্ডে লড়াই করছিলেন। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তিনি মান্যতা পেতেন। অথচ, তিনিই জেলে ঠাঁই পেলেন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হবে বলে এই পারকিনসন রোগে আক্রান্ত কে জল খাওয়ার জন্য স্ট্র টুকুও দেওয়া হয়নি। জল ভরতি গ্লাস ধরতে হাত তাঁর কাঁপছে দেখেও কারা কর্তৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়েছে ওই হাতে বুলেট ঠাসা পিস্তল কল্পনা করে। ছাড়া তো দূর অস্ত তাঁকে জামিন দিতেও চায়নি ভারতীয় প্রশাসন।
এবং স্টান স্বামী কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি নন। এহেন চেনা পরিণতির অপেক্ষায় এখনও জেলে দিন গুনছেন অনেক চেনা ও অচেনা নাম। জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে অপেক্ষমান নাগরপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান সোমা সেন। টানা তিন তিনটে বছর কারা কুঠুরিতে জন্মদিন পালন তাঁর। একই নিয়তি যাপন সুধা ভরদ্বাজের। অর্থনীতিবিদ এবং ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সক্রিয় কর্মী। অভিন্ন দৈনন্দিন রোনা উইলসনের। রাজনৈতিক মামলায় জেলে পচছেন যাঁরা, তাঁদের আইনি সাহায্য দিতে দিতে তিনিও এখন জেলে। আছেন আরও অজস্র মুখ। এঁদের একটাই সাধারণ পরিচয় , এঁরা মানবাধিকার কর্মী।
আরও পড়ুন : বাংলা জয়ের পর প্রথম দিল্লি সফরে নেত্রী
_মানবাধিকার একটি গর্হিত উচ্চারণ_
এই শাসক তো সেই দানব, যে অশ্লীল অট্টহাসিতে উপেক্ষা করে অন্নদাতা চাষীর চোখের জল। যে নির্লজ্জ উদাসীনতায় স্বীকার করতে চায় না যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বুনোট। যে অনৈতিক উল্লাসে ক্রোনি পুঁজিবাদের চুল্লিতে আগুন জিইয়ে রাখতে যোগান দেয় আম আদমির মাংস, বেঁচে থাকার অধিকার। সুতরাং মানবধিকার কথাটা ইতিহাসে নাৎসি জমানার আগে কেউ শোনেনি। এ নিয়ে কেউ তৎপরতাও কেউ দেখায়নি রাষ্ট্র সংঘর মঞ্চ থেকে মানুষের অধিকার নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের আগে। এসব যখন দেশে দেশে দিকে দিকে চলছিল, তখন সদ্য স্বাধীন ভারত ব্যস্ত ছিল সংবিধান রচনার কাজে। সেই সংবিধানের অন্তরাত্মায় তখন বসছিল বাক স্বাধীনতার মূর্তি। সাম্যের মন্দির ন্যায়ের বেদী নির্মাণের তাগিদ তাতে মিশে ছিল। আর আজ, স্বাধীনতার সাত দশক পার করে, সেই দেশে নেমে এসেছে ডেমোক্লেসের খাঁড়া। দিকে দিগন্তে চলছে মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়ার আয়োজন। আদিবাসীকে বনবাসী তকমা দিয়ে উত্তর ভারতীয় আর্য সংস্কৃতির আগ্রাসী সম্প্রচার। একদা যে দেশে নির্যাতিত মানুষের সেবা পরায়ণতাকে সম্মানিত করেছিলাম আমরা মাদার টেরিজাকে ভারতরত্ন দিয়ে , সেই দেশেই আজ স্টান স্বামীর মতো মানুষদের জেলে পুরে মেরে ফেলা হচ্ছে।
কার পাপে মাথা এবার নত করব আমরা। এ তো সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শনকারী শাসকের পাপ। এ তো সংবেদনশীলতাহীন শাসকের লজ্জা।
_আজব গনতন্ত্র রে ভাই আজব গনতন্ত্র_
পেট্রোল ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম লাগাম ছাড়া । গঙ্গায় কোভিডে মৃতদের লাশ বয়ে যায়। আর তার জন্য কাউকে জেলে ঢোকানো দূরের কথা, উলটে দোষীদের পিঠ চাপড়ানি জোটে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছিলেন, শক্তিমানের চক্ষুলজ্জা থাকে না। কথাটা যে কতটা সত্যি, সেটা প্রতিদিন কেন্দ্রের দানবতন্ত্র বুঝিয়ে ছাড়ছে।
এই আজব গনতন্ত্রে উপেক্ষিত সংসদে আলোচনা। সংসদের বাইরে শান্তিপূর্ন আন্দোলনকারীদের উপেক্ষা করাটাই না কী রণনীতি। এই বিচিত্র গনতন্ত্রে চর বৃত্তি প্রশাসনের একমাত্র গুরুত্বপূর্ন কর্ম হয়ে ওঠে। ইউ এ পি এ আইনই একমাত্র প্রয়োগের অবকাশ খুঁজে পায়। রাজনীতির ছাত্র মাত্রই জানেন, শাসন ব্যবস্থা যেরকমই হোক না কেন, তার লক্ষ্য জন কল্যাণ। স্বৈরতন্ত্রের সুরে আলাপ আলোচনার কোনও সুর থাকে না। কিন্তু গনতন্ত্রে সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমেই পদক্ষেপের দিশা স্থির হয়। এটুকুই পার্থক্য। এই টুকুই।
আরও পড়ুন: Breaking: ২৮ জুলাই দিল্লির বঙ্গভবনে বৈঠক ডাকলেন তৃণমূলনেত্রী
কিন্তু আজকের ভারতে ওই জনস্বার্থের লক্ষ্যই রোজ বলি হচ্ছে। জল্লাদের ভূমিকায় কেন্দ্রীয় সরকার।
এই দিশাহারা রঙ্গে গুনগুনিয়ে উঠছে কয়েকটা পঙক্তি। বিমলচন্দ্র ঘোষের লেখা।
” আজব গনতন্ত্র রে ভাই আজব গনতন্ত্র
গণের জোরেই গণকে ঠকায় গণদ্বেষী মন্ত্র।।…
চোর ডাকাতও মুক্তি পেল, মুক্তি পেল খুনে
বন্দি করে রাখল শুধু ওদের গুনে গুনে।।
কারণ ওরা ধৈর্যহারা তরুণ দেশব্রতী,
ছাড়লে ওদের শাসক শোষক স্বৈ র চারীর ক্ষতি।।
দুই ফ্যাসিস্ট
সুবোধ সরকার
সক্রেটিসকে কারা দেয় হেমলক?
জ্যোৎস্নায় যারা গুলি করে মারে বক।
“তুলে ফেলে দিন মরা রবীন্দ্রনাথ”
“আকাশে থাকবে কেবল একটা চাঁদ”।
হেরে গিয়ে আজ দুটো লোক রেগে কাঁই
“দেখে নেব চল্ ইতিহাস পাল্টাই”।
যাদের এখনো দুটো মাথা আছে ঘাড়ে
স্ট্যান স্বামী হয়ে মাথা না তুলতে পারে।
যারা সাঁওতাল কোল ভিল জনজাতি
“তছনছ করো ওদের আসল ঘাঁটি”।
শহরে শহরে সক্রেটিসের লোক
“ওদের সঙ্গে চাই না তর্ক হোক”।
সূর্যের তেজে জঙ্গলে ওরা জোটে
“দেখে নেব কাল কী করে সূর্য ওঠে”।