সূচনা পর্ব
প্রখ্যাত পরিচালক বিজয় ভাট তখন ছবি করতে চলেছেন। ‘বৈজু বাওরা’। এক সঙ্গীত সাধকের জীবন নিয়ে ছবি। সুরকার হিসেবে তিনি নিলেন ভারত বিখ্যাত নৌশাদকে। নামভূমিকার শিল্পী তখনকার দিনের স্টার আর্টিস্ট ভারতভূষণ। অজস্র জনপ্রিয় গানে সমৃদ্ধ সেই ছবি। প্রথমে নৌশাদ শিল্পী নির্বাচন করেছিলেন তখনকার দিনের সংগীত জগতের সুপারস্টার তালাত মাহমুদকে। গানের রিহার্সাল চলাকালীন নিয়মিত তালাত মাহমুদ বাইরে গিয়ে ধূমপান করে আসছিলেন। একবার-দু’বার হলে হয়, বারংবার রিহার্সাল রুম ছেড়ে সিগারেট খেতে বাইরে যাচ্ছিলেন তালাত মাহমুদ। তা দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হলেন নৌশাদজি। ক্ষিপ্ত হলেন। শিল্পীকে কিছু বলতেও পারছিলেন না। সেই সময় বাবার লেখা চিঠি নিয়ে এক যুবক নৌশাদজির কাছে এলেন। যুবকটি ইতিমধ্যে খানকয়েক রেকর্ড করেছেন। তবে সাড়া ফেলতে পারেননি। যুবকটির জন্য সুপারিশ করে পাঠিয়েছেন নৌশাদের বাবা। তিনি যুবকটির ভয়েস টেস্ট নিলেন। বৈজু বাওরার গানগুলি যুবকটিকে দিয়ে তিনি রিহার্সাল দেওয়ালেন। যুবকটির নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হলে নৌশাদ। তখন ওই যুবকটি নির্বাচিত হয়ে গেলেন বৈজু বাওরার গানগুলি গাইবার জন্য। একক কণ্ঠে যুবকটির দুটি গান ‘ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে’ এবং ‘মন তারপাত হরিদর্শনকো’ সঙ্গীতপ্রেমীদের মনকে আলোড়িত করল। সেই যুবকের নাম মহম্মদ রফি। ভারতের নতুন তানসেন বলে রফিকে চিহ্নিত করেছিলেন নৌশাদজি। নৌশাদের সাহচর্যে রফি নিজেকে হিন্দি সিনেমার জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও কিংবদন্তি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আর কিন্তু ফিরে তাকাতে হয়নি। মহম্মদ রফি নৌশাদের সুরে বিভিন্ন ছবিতে মোট ১৪৯টি গান গেয়েছেন। তার মধ্যে একক সংগীত ছিল ৮১টি।
আরও পড়ুন-সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরও সময় কাটাব, অবসর পরিকল্পনায় ধোনি
জীবন রেখা
১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পাঞ্জাবের অমৃতসরে রফির জন্ম হয়। রফির ডাকনাম ছিল ফিকু। তাঁর নিজের গ্রামের এক ফকিরের ভজন গানকে অনুকরণ করে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন রফি। রফির দাদার বন্ধু আব্দুল হামিদ রফির সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তাঁকে গান গাইতে উৎসাহ দিতেন। পরে তিনি রফির শ্যালকও হয়েছিলেন। হামিদের সঙ্গে রফি বোম্বেতে আসেন। সঙ্গীত শিক্ষা করেন বড়ে গোলাম আলি খান, ওস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবন লাল মত্তো প্রমুখ শিল্পীদের কাছে। ভারত ভাগের সময় রফি ভারতে স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর সহশিল্পী নুরজাহান অবশ্য পাকিস্তানে চলে যান। দু’বার রফি বিয়ে করেছেন। ভারত ভাগের জন্য প্রথমা স্ত্রীকে অভিবাসন আইনের দরুন ভারতে আনতে পারেননি। স্ত্রী রয়ে গেলেন লাহোরে। সেই পক্ষে একটি সন্তান। মুম্বই তৎকালীন বোম্বেতে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। তাঁর নাম বিলকিস বানো। এই পক্ষে তিন পুত্র, তিন কন্যার জনক তিনি। মদ খেতেন না। ধূমপান করতেন না। রেকর্ডিং রুম থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে রেকর্ডিং রুম— এরই মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। চলচ্চিত্রের পার্টিতে কখনও যেতেন না। শুরুতে তিনি গান-পিছু পেতেন ৫০ থেকে ৭০ টাকা। পরে সেই টাকার অঙ্ক গিয়ে পৌঁছল প্রতি গানে আঠারো হাজার থেকে কুড়ি হাজার টাকা।
আরও পড়ুন-৪৮ ঘণ্টায় গাজায় নিহত ৩৯০, পারস্পরিক দোষারোপ চলছেই
বিভিন্ন সুরকারদের সুরে গান
গুরু দত্ত ও দেবানন্দের মুখের গানগুলি শচীন দেববর্মণ সর্বদা রফিকে দিয়ে গাওয়াতেন। গুরু দত্তের জন্য গাওয়ালেন পিয়াসা, কাগজকে ফুল ছবিতে। দেবানন্দের জন্য গাওয়ালেন তেরে ঘরকে সামনে, গাইড প্রভৃতি ছবির জন্য। রাজেশের জন্য আরাধনা, অমিতাভের জন্য অভিমান ছবিতে রফি গাইলেন।
রফি ছ’বার
ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রথমবার পেয়েছিলেন রবির সুরে চৌধবি কা চাঁদ ছবি থেকে। নীলকমল ছবিতে ‘বাবুল কি দোয়ায়েন লেটি যা’ গানের জন্য তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই গানটি গাইবার সময় তিনি খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন। সুরকার রবি ও গায়ক রফির জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আছে চায়না টাউন, কাজল প্রভৃতি।
শঙ্কর জয়কিসানের সঙ্গে রবির সম্পর্ক ছিল দারুণ। এঁদের সুরে শাম্মি কাপুর ও রাজেন্দ্র কুমারের লিপে বহু হিট গান রয়েছে। রফি ছটি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন। তার তিনটির সুরকার এঁরা। যার মধ্যে রয়েছে বাহারো ফুল বারসাও! (সুরজ), তেরি পেয়ারি পেয়ারি সুরত কো (শ্বসুরাল), দিল কি ধারকো মে (ব্রহ্মচারী।) শঙ্কর জয়কিসানের সুরে ‘ইয়াহু, চাহে কহি মুঝে’ গানটি যেভাবে রফি গেয়েছেন ‘জংলি’ ছবিতে, তার কোনও তুলনা নেই। ‘সারারাত’ ছবিতে এই জুটি কিশোরকুমারের বদলে মহম্মদ রফিকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। এই জুটির সুরেই রফি বসন্তবাহার, দিল তেরা দিবানা, ইয়াকিন, প্রিন্স, লাভ ইন টোকিও, বেটি বেটে, দিল এক মন্দির, যব পেয়ার কিসিসে হোতা হ্যায় প্রভৃতি ছবিতে গান গেয়েছিলেন।
সুরকার ও পি নাইয়ারের সুরে মহম্মদ রফি ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বহু বহু হিট গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। তিনি বলতেন ‘যেখানে রফি নেই সেখানে ও পি নাইয়ারও নেই’। তিনি কিশোরকুমারের লিপে রফিকে দিয়ে ‘রাগিণী’ ছবিতে গাইয়েছিলেন ‘মান মেরা বাওয়ারা’ গানটি। রফি ও আশা ভোসলে জুটিকে দিয়ে কাশ্মীর কি কলি-সহ বহু ছবিতে গাইয়েছিলেন। এই ছবিতেই রফির গাওয়া ‘তুমনে বানায়া’ গানটি আজও জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন-গোয়ার কাছে লজ্জার হার মোহনবাগানের
লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারিলাল এই জুটির সঙ্গে রফি বহু হিট গান গেয়েছেন। এই জুটির প্রথম ছবি ‘পরশমণি’তে রফি গেয়েছিলেন। ‘দোস্তি’ ছবির গানগুলি তো আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পেলেন এই দোস্তি ছবির ‘চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে সাঝ সভেরে’ গানটির জন্য।
লতার সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদ
লতা এবং রফি যখন একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে চলেছেন, তখন লতা মঙ্গেশকর গানের জন্য রয়্যালটি দাবি করলেন প্রযোজকদের কাছে। তিনি ভেবেছিলেন রফি তাঁকে এ-ব্যাপারে সমর্থন করবেন। কিন্তু রফি বিষয়টি সমর্থন করতে পারলেন না। রফির মতে, প্রযোজক যখন শিল্পীর দাবিমতো গানের জন্য পয়সা দিয়েছেনই সেখানে সেই গানের জন্য রয়্যালটি চাওয়াটা অনুচিত। লতা বিষয়টিতে অসন্তুষ্ট হয়ে বছর তিনেক আর গানই করলেন না রফির সঙ্গে। অবশেষে শঙ্কর জয়কিসানের মাধ্যমে তাঁরা আবার একত্রে ডুয়েট গান করলেন। ছবির নাম ‘পালকোকে ছাঁও মে’। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হল এই যে, রফির জীবনের শেষ গানটি কিন্তু এই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেই। ছবির নাম ‘আশপাশ’। আনন্দ বক্সির কথায় ধর্মেন্দ্র ও হেমা মালিনীর লিপে মহম্মদ রফি ও লতাজি গাইলেন ‘তু কাহিন আশপাশ হো দোস্ত’।
আরও পড়ুন-কুণালের সঙ্গে বৈঠকে এসে বিস্ফো.রক দাবি করলেন চাকরিপ্রার্থীরা, ২৭ লক্ষ নিয়ে প্রতা.রণা বিকাশের
কিছু টুকরো খবর
মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজেন্দ্রকৃষ্ণের কথায় রফি গেয়েছিলেন ‘বাপুজি কি অমর কাহানি’। গানটি শ্রোতৃমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে তাঁর বাসভবনে গিয়ে এই গান রফি শুনিয়ে এসেছিলেন। মুগ্ধ করেছিলেন নেহরুকে।
জনৈক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর তাঁর কাছে জীবনের শেষ ইচ্ছাটুকু জানতে চাওয়া হয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো জীবনটাকেই চাইবেন অথবা অন্য কিছু চাইবেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে দণ্ডিত আসামি জানালেন যে, রফির গাওয়া ‘ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে’ গানটি তিনি শুনতে চান।
দিলীপকুমার-মধুবালা অভিনীত ‘মুঘল ই আজম’ ছবিতে ‘প্যার জিন্দাবাদ’ গানটিতে রফি ১০০ জন সহশিল্পী নিয়ে গেয়েছিলেন। এ-এক ইতিহাসই বটে।
‘অমর আকবর অ্যান্টনি’ ছবিতে ‘হামকো তুমসে হো গেয়া প্যার’ গানে কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকার, মুকেশের সঙ্গে রফিও গেয়েছিলেন। এটি সম্ভবত একমাত্র গান যেখানে এই চারজন বিখ্যাত শিল্পী একত্রে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-ইচ্ছাকৃত জটিলতা বোসের, সমাবর্তনের আগে বর.খাস্ত ভিসি
একদিন গাড়ি করে রফিজি যাচ্ছিলেন। বোম্বেতে তখন প্রচণ্ড গরম। তিনি দেখলেন একটি লোক রাস্তায় খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। একবার একটি পা মাটিতে রাখছে। পরে আবার সেই পা তুলে নিয়ে অন্য পা মাটিতে রাখছে। ড্রাইভারকে তিনি গাড়ি থামাতে বললেন। সেই নগ্ন পায়ের লোকটিকে নিজের সেদিন পরে থাকা চটি জোড়া দিলেন। রফির কন্যা নাসরিন আহমেদ এই কথা জানিয়েছেন।
রফির জামাই মিরাজ আহমেদ আরেকটি ঘটনা জানিয়েছেন তাঁর শ্বশুরমশাই সম্পর্কে। এককালের বিখ্যাত গায়ক বর্তমানে বিস্মৃতপ্রায় খান মাস্তানকে একদিন রফি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তখন গাড়ি থামিয়ে তাঁকে গাড়িতে তুলে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। স্নান করালেন। ভাল করে খেতে দিলেন। তারপরে তাঁকে ছাড়লেন।
বিভিন্ন নায়কের গলায় গেয়েছেন তিনি। সেই তালিকায় রয়েছেন দিলীপকুমার, দেব আনন্দ, গুরু দত্ত, শাম্মি কাপুর, রাজেন্দ্রকুমার, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, ঋষি কাপুর-সহ বিখ্যাত নায়কেরা। উত্তমকুমারের লিপে গেয়েছেন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ছবিতে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
সায়গলের আশীর্বাদ প্রাপ্তি
লাহোরে থাকাকালীন তেরো বছরের বালক মহম্মদ রফি গিয়েছেন ভারতখ্যাত গায়ক কুন্দনলাল সায়গলের গান শুনতে। স্টেডিয়াম ভর্তি লোক। হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে যাওয়ায় সায়গল মাইক ছাড়া খালি গলায় গাইতে শুরু করলেও সুবিধা করতে পারছিলেন না। গলা শ্রোতাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছচ্ছিল না। তখন ১৩ বছরের গায়ক রফি শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে গান ধরলেন। খালি গলায়। মাইক ছাড়া। তাঁর কণ্ঠস্বরে আস্তে আস্তে শ্রোতারা বসতে শুরু করলেন। খানিক পরে শ্রোতারা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনলেন রফির গান। অনুষ্ঠানের শেষে সায়গল নিজের আসন থেকে উঠে এসে রফিকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যে, একদিন তাঁর এই কণ্ঠস্বর সর্বত্র সমাদৃত হবে। সায়গলের আশীর্বাদ বিফলে যায়নি।
বহু ভাষার গানের শিল্পী
রফি হিন্দি গানের পাশাপাশি উর্দু, ভোজপুরি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, বাংলা, মারাঠি, কানাড়া, গুজরাটি, তেলুগু প্রভৃতি ভাষাতেও গেয়েছেন। উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষের সুরে একটি হিন্দি গান ‘সব কুছ লুটকর’। বাংলা গানগুলির মধ্যে বিখ্যাত হল : না না পাখিটার বুকে যেন তির মেরো না, আলগা করো গো খোপার বাঁধন, কথা ছিল দেখা হলে, ওই দূর দিগন্ত পারে, তোমার নীল দোপাটি চোখ, এ জীবনে যদি আর কোনওদিন, তোমাদের আশীর্বাদে প্রভৃতি গানগুলি।
আরও পড়ুন-জেব্রা ক্রসিং
শেষের সেদিন
মহম্মদ রফি ১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই মাত্র ৫৫ বছর বয়সে রাত দশটা পঁচিশে আমাদের ছেড়ে চলে যান। তিনি চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর গাওয়া গানগুলি তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। আজও আমরা মুগ্ধ হয়ে আছি তাঁর গানে। শিল্পীর উদ্দেশে রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।