ডায়াবেটিস থাকলে এক নয়, একাধিক জটিল শারীরিক সমস্যা আসতে পারে। তাই একে সাইলেন্ট কিলার বলা হয়। বিশ্বজুড়ে আজ ডায়াবেটিস নিঃশব্দ ঘাতকের মতো থাবা বসাচ্ছে। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত যে ব্যক্তি তাঁর হার্ট, চোখ এবং কিডনি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথম থেকেই সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হতে পারে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। যা একটি জটিল চোখের অসুখ। টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস— এই দুইয়ের ক্ষেত্রেই আসতে পারে এই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (Diabetic Retinopathy)। যাঁদের পারিবারিক ইতিহাসে সুগার রয়েছে বা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাঁদেরই এই রোগের সম্ভাবনা বেশি।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যথি (Diabetic Retinopathy) কখন হয়
ডায়াবেটিস যদি দীর্ঘদিন ধরে থাকে তাহলে রেটিনার ওপর ক্রমাগত চাপ পড়ে। ফলে রেটিনার রক্তনালিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেটিনা হল আপনার চোখের পিছনের টিস্যুর একটি স্তর, যা চোখ যে চিত্রগুলি দেখে সেগুলিকে স্নায়ু সংকেতে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। যাতে মস্তিষ্ক সেগুলি বুঝতে পারে। চোখের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ুর সঙ্গে যোগ থাকে রেটিনার সঙ্গে। আমাদের ইমেজ তৈরি হয় এই রেটিনায়।
যখন এই রেটিনার রক্তনালিগুলি কোনও ক্ষতির সম্মুখীন হয়, এই রক্তনালি ব্লক হয়ে যেতে পারে। এটি রেটিনার কিছু রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে রক্তপ্রবাহের ক্ষতি হয়। কিছু অস্বাভাবিক রক্তনালি তৈরি হয় এবং বৃদ্ধি পায় এই নতুন রক্তনালিগুলি ফুটো হতে পারে এবং ছোট-ছোট সাদা ছোপ (ইডিমা) পড়ে, তখন স্পষ্ট ইমেজ তৈরি হয় না। দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হয়ে যায়। যে কারণে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারেন রোগী। এই সমস্যাই হল ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (Diabetic Retinopathy)। যত দিন গড়ায় ধমনীতে রক্ত চলাচলের সমস্যা আরও বাড়ে এবং রেটিনার বিভিন্ন অংশে ঠিকমতো অক্সিজেন পৌঁছয় না। তখন সেই কাজটি করে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য নালি। কিন্তু তারাও রেটিনার নানা রক্ত পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়। এই দুর্বল নালি ফেটে চোখে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলে ভিট্রিয়াস হেমারেজ। এগুলো সবটাই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জটিল পর্যায়। একে চিকিৎসার পরিভাষায় প্রলিফারেটিভ রেটিনোপ্যাথিও বলে। এর থেকে আজীবন অন্ধত্ব আসতে পারে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রথম অবস্থায় অতটা বোঝা যায় না। সাধারণত হালকা দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় কারও কারও। তবে ঠিক সময় ধরা না পড়লে দৃষ্টিশক্তি হারানোর প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
যদিও শুধু ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নয়, ডায়াবেটিসের রোগীদের চোখে নানা ধরনের কমপ্লিকেশন হতে পারে। চোখের মধ্যে যে ল্যাক্রাইমাল গ্রন্থি থাকে, তার ক্ষরণ কমে গেলে সেখান থেকে শুষ্কতার সমস্যা তৈরি হয়। এই শুষ্কতা যদি দীর্ঘদিন থাকে তখন ক্যাটারাক্ট হয় বা চোখে ছানি পড়ে। ছানি পড়লে অস্ত্রোপচার ছাড়া গতি থাকে না।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির টাইপ ১ এবং টাইপ ২ দুই ধরনের ডায়াবেটিসেই আসতে পারে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে এটা তুলনায় পরে আসে কিন্তু টাইপ ১ ডায়াবেটিস জিনগত কারণে এবং অনেক কম বয়সেই হয়। তাই ডায়াবেটিসের একটা দীর্ঘ ইতিহাস এদের থাকে। ফলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সম্ভাবনা এদের অনেক বেশি।
রেটিনোপ্যািথি চিনবেন কীভাবে
এই রোগে চোখের সামনে পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে হবে।
ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে।
কিছু পড়তে বা দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধে হয়।
দৃষ্টির মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।
ফ্লোটার বা গাঢ় দাগ দেখা যায়।
রাতে দেখতে বেশ অসুবিধে হয়।
রং আলাদা করতে অসুবিধে হয়।
পরবর্তীকালে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এই ধরনের উপসর্গ দেখলেই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা সাধারণত বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করান। এগুলির মধ্যে রয়েছে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, চোখের স্ক্যান।
আরও পড়ুন- মাত্র ৪ মাসে কর্মসাথী প্রকল্পে নথিভুক্ত ২০ লক্ষের বেশি পরিযায়ী শ্রমিকের নাম
কখন ঝুঁকি বাড়ে
যাঁরা ডায়াবেটিসকে পাত্তা দেন না। অবহেলা করেন বা নিয়ম মেনে চলেন না, তাঁদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হাই ব্লাড প্রেশার, হাই কোলেস্টেরল থাকলে এই রোগে ঝুঁকি বাড়ে।
ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে অত্যধিক চর্বি জমলে, কোনও শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম না করলে বা সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকলে এই রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গর্ভবতী মহিলার রেটিনোপ্যাথি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
নিয়মিত ধূমপান করেন যাঁরা তাঁদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সম্ভাবনা রয়েছে।
কী কী পরীক্ষা করা যেতে পারে
ফ্লুরেসসিন অ্যাঞ্জিওগ্রাফি টেস্ট : এই পরীক্ষায় রোগীকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে লিক হওয়া রক্তনালিগুলোতে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
অপটিক্যাল কোহেরেন্স টমোগ্রাফি (OCT): এটির সাহায্যে চিকিৎসক রেটিনার টিস্যুতে কতটা তরল লিক হয়েছে তা নির্ধারণ করতে পারেন।
এই সব টেস্টের পর ইঞ্জেকশন, লেজার ট্রিটমেন্ট এবং ভিট্রেক্টমির ইত্যাদি চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। লেজ়ার থেরাপি, চোখের ইঞ্জেকশন বা স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দিয়ে দৃষ্টিশক্তি আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
ইঞ্জেকশন : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসায় দু’ধরনের ওষুধ রয়েছে যা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয় এই ইঞ্জেকশনগুলি রেটিনায় অস্বাভাবিক রক্তনালিগুলির বৃদ্ধিকে ধীর করতে সাহায্য করে।
লেজার ট্রিটমেন্ট : এই পদ্ধতি ফটোক্যাগুলেশন নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে রেটিনায় অস্বাভাবিকভাবে ক্রমবর্ধমান রক্তনালিগুলিকে কমিয়ে দেওয়া হয়।
ভিট্রেক্টমি : এটি একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি যা একটি ছোট্ট ফুটো করে রেটিনা এবং ভিট্রিয়াস থেকে রক্ত এবং দাগের টিস্যুগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
শুধু চোখ নয়, শরীরের যে কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সুরক্ষিত রাখতে ডায়াবেটিসকে রোখা দরকার। যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁদের খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ শুধু ঠিকঠাক ডায়েটে আপনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। দু’ধরনের কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। প্রথমটি, চাল এবং চিনির মতো সাধারণ কার্বোহাইড্রেট যা আমাদের দেহে দ্রুত ভেঙে যায় এবং দ্রুত শক্তি দেয়। দ্বিতীয়, কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, যেমন গম, ভাঙতে বেশি সময় নেয় এবং ধীরে ধীরে আমাদের শক্তি দেয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এই কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খেতে হবে। জল খেতে হবে পর্যাপ্ত। প্রতিবার ইউরিনের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত গ্লুকোজ বেরিয়ে যায়। দেখতে হবে ওজন যেন সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে।