‘পাঁচ এবং ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে গীতাপাঠ স্পেশ্যাল ট্রেন (Special Train- BJP Govt) আসছে। সাধারণ যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে ওই ট্রেনে উঠবেন না।’
গত ২৪ ডিসেম্বর ব্রিগেড গ্রাউন্ডে গীতাপাঠ কর্মসূচির জন্য ভারতীয় রেল স্পেশ্যাল ট্রেনের ব্যবস্থা রেখেছিল। এবং ওইদিনই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর টেট পরীক্ষার সেন্টার পড়েছিল। তার জন্য কিন্তু রেল কোনও ট্রেনের ব্যবস্থা করেনি।
বহু ধর্মের অনুসারী ভারতীয় সংস্কৃতির যুগ যুগ ধরে চলে আসা নানা ধর্মীয় উৎসবের জন্য এতদিন গঙ্গাসাগর স্পেশ্যাল ট্রেন, কুম্ভমেলা স্পেশ্যাল ট্রেন, রথযাত্রা স্পেশ্যাল ট্রেন (Special Train- BJP Govt) শুনেছি। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের ধর্মীয় কর্মসূচির জন্য স্পেশ্যাল ট্রেন চলছে এর থেকে খারাপ উদাহরণ আর কিছু হয় না।
বিজেপির এই অদ্ভুতুড়ে কর্মসূচির জন্য আমাদের ছাত্রছাত্রীরা সেদিন ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরেছে। হাওড়া, শিয়ালদহতে নেমে বাস, টাক্সি পেতে কালঘাম ছুটে গেছে। বহু জায়গায় পুলিশের সহায়তায় তারা সেন্টারে পৌঁছেছে। কেউ-বা দেরি হয়ে যাবার উৎকণ্ঠায় কান্নাকাটি করছে। কারণ সেদিন ঘন কুয়াশায় সব ট্রেন লেট চলছিল। ফলে সঠিক সময়ে সেন্টারে পৌঁছনোর চিন্তা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। সামনে দিয়ে গীতাপাঠের জন্য ড্যাংড্যাং করে ট্রেন বেরিয়ে যাচ্ছে সেখানে রাজ্যস্তরের একটি পরীক্ষার জন্য ট্রেন নেই। উল্টে আবার স্টেশনে স্টেশনে ঘোষণা হচ্ছে গীতাপাঠ স্পেশ্যাল ট্রেনে কেউ উঠবেন না!! এই নোংরা রাজনীতি বিজেপি ছাড়া আর কেই-বা করতে পারে!!
বিজেপি দলটার কাছে আমার প্রশ্ন গীতাপাঠটা কি টেট পরীক্ষার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এরপর তো মা-ঠাকুমাদের সত্যনারায়ণ পুজোয় সিন্নিদান, লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ার মতো কর্মসূচিও পালন হবে ব্রিগেডে। কারণ আপনাদের রাজনীতি মানুষের জন্য নয়। আপনারা জন্মাবধি ধর্মের সুড়সুড়িতেই বিশ্বাসী। তাই বিজেপির আজ পর্যন্ত কোনও সুস্থ চিন্তার কর্মসূচি বা কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যায় না কোথাও।
বাস্তব হচ্ছে, এরা মনেই করে না ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎই দেশের ভবিষ্যৎ। গীতাপাঠ নয়। তারা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। সেখানে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির কোনও স্থান নেই। আর সেই কারণেই টেট পরীক্ষার জন্য সেদিন ছাত্রছাত্রীদের যেতে-আসতে দুবারই হয়রান হয়েছে। বিজেপি যদি এতই বাংলাদরদি হত তাহলে এদের জন্য কি একটা ট্রেনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ রেলকে করত না?
বিগত দু’দিন ধরে অপেক্ষা করে দেখলাম একটা ধর্মীয় কর্মসূচির জন্য স্পেশ্যাল ট্রেন চালানোর লজ্জাজনক এই খবরটি টিভি, কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়ার কেউই অবগত নন। তাদের তো মনেই ছিল না যে সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও রয়েছে। তার ব্যবস্থাপনা আদৌ যথাযথ কিনা সেটা দেখার থেকেও মিডিয়া ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সভার নানা অ্যাঙ্গলের ছবি দিতেই বেশি উৎসাহী ছিল সারাদিন। পরীক্ষাটরিক্ষা এসব তো আর মিডিয়াকে টিআরপি দিয়ে বড়লোক করে না!
আরও পড়ুন- মায়াবতীকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ ঘোষণার দাবি বিএসপির, ইন্ডিয়ায় যোগ দিতে অবাস্তব শর্ত আরোপ
আসলে আজকাল সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কেউ কোনও খবরই রাখেন না। সাংবাদিকতা ছেড়ে দেওয়ার প্রায় দশক পেরিয়ে যাবার পরও এই খবর আমি ২৪ তারিখ সকালে ঘরে বসেই পেয়েছি। আমি যদি এই খবর বাড়িতে বসেই পাই তাহলে অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থকেরা এটা জানে না কেন? জানে না বলেই এরকম একটা ঘটনার চারদিন কেটে গেলেও তাদের এই বিষয়ে কোনও প্রতিবাদ তো দূরঅস্ত্ সামান্য বক্তব্য পর্যন্ত শুনিনি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’… এই বিশ্বাসে ভরসা রেখে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই বিষয়ে প্রতিবাদ করা দরকার বলে মনে করি। তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও এ-নিয়ে আত্মবীক্ষণ আবশ্যক। ইস্যুটা জনসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব তো তাদেরই নিতে হবে। সেটাই তো সময়ের দাবি।
যাই হোক, মানুষের ধর্মাচরণ তার একান্ত অনুভূতির বিষয়। ধর্মের আধারে নিজেকে সঁপে মানুষ শান্তি খোঁজে। সেই আত্মিক উপাসনালয়টি কোনও মাঠ-ময়দান হতে পারে না। কিন্তু ধর্ম ছাড়া বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শ পচা ডোবার মতোই উদ্দেশ্যহীন। আর বাংলা চিরকালই বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনাচিন্তায় অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক এগিয়ে তাই এখানে বিজেপি এখনও পর্যন্ত ধর্মকে ঢাল করে সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ। তবুও চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। তারই একটি এই গীতাপাঠ।
আমি জানি, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে এইরকম কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জনমানসে বিজেপি তাদের ভোট বৃদ্ধির লক্ষ্যে নামবে এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু জেনে রাখুন তাতে লাভ কিছু হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেবেন ততদিন এইসব ধর্মীয় এজেন্ডায় বাংলা দখল করার অদ্ভুতুড়ে রাজনীতিতে বিজেপি আঁচড়টুকুও কাটতে পারবে না