মোদির মন্ত্রী মায়া কোদনানি। সঙ্গে আরও ৩২ জন দাঙ্গাবাজ। তাঁরা জেলে গিয়েছিলেন তাঁরই রায়ে, নারোদা-পাটিয়া গণহত্যা মামলায়। বিচারকের পদে আসীন থাকার সময়েই এক আধবার নয়, অন্তত ১৮ বার প্রাণনাশের হুমকি শুনেছিলেন। দ্বিস্তরীয় নিরাপত্তা পেয়েছিলেন। তবে সেটা রাজ্য সরকারের সতর্কতার বা উদ্বেগের কারণে নয়। স্রেফ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। গতবার দেওয়ালির পর থেকে তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আসেননি কোনও সিআইএসএফ জওয়ান তাঁর বাড়ির বাইরে। তাঁকে নিরাপদে রাখার দায় নিয়ে। এবার শেষমেশ গুজরাতের বিজেপি সরকার তাঁর নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিল। একেবারে সরকারিভাবে ঘোষণা করে।
তাঁর নাম জ্যোৎস্না ইয়াগনিক, আমেদাবাদের অবসরপ্রাপ্ত সিটি সেশন জাজ। তিনি একা নন। আরও ১৫ জন সাক্ষী, আইনজীবী ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নিরাপত্তা প্রত্যাহার হয়েছে। সৌজন্যে গুজরাতের বিজেপি সরকার। উল্লেখযোগ্যভাবে ওই সাক্ষী, আইনজীবী, বিচারপতিরা সবাই গুজরাতের গণহত্যা মামলাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আর এই ঘটনাটা তখনই ঘটানো হল যখন মায়া কোদনানি থেকে বাবি বজরঙ্গী, গুজরাত দাঙ্গা আর গুজরাতের গণহত্যায় জড়িত অভিযুক্তরা জেলের বাইরে। বিন্দাস আছেন তাঁরা। ২০২৩-এর এপ্রিল মাসেই নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম গণহত্যা মামলার মায়া কোদনানি-সহ ৩৭ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে গুজরাতের বিশেষ আদালত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই মামলায় ৯৭ জন সংখ্যালঘু মানুষকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ ছিল। আজ থেকে ১৫ বছর আগে নারোদা পাটিয়া, নারোদা গাম, গুলবার্গ সোসাইটি-সহ নয়টি মামলায় সাক্ষী, বিচারপতি প্রমুখদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করেছিল সুপ্রিম কোর্ট।
এখন নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা হয়েছে যাঁদের, তাঁরা চরম শঙ্কার প্রহরে নিমজ্জিত। তাঁদের স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসছে দাঙ্গার গণহত্যার নৃশংস প্রহরের আতঙ্ক। এঁদের মধ্যে আছেন ইমজিয়াজ খান, গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা মামলায় অন্যতম প্রধান সাক্ষী। আছেন এস এম বোরা। ওই মামলার আইনজীবী। তাঁর নিরাপত্তা যে তুলে নেওয়া হয়েছে সেটা সরকারিভাবে জানানোরও দরকার মনে করেনি কেউ। আছেন ফরিদা শেখ, বয়স ৫৪ বছর। নারোদা পাটিয়া গণহত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী। আছেন ইকবাল বালোচ। দীপদা দরওয়াজা মামলার অন্যতম সাক্ষী।
গুজরাত সরকার জানিয়েছে, গত ১৩ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)-এর তরফে আমেদাবাদ পুলিশকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠি পেয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখার পর সাক্ষী প্রমুখের সুরক্ষা প্রত্যাহার হয়। সিটের উইটনেস প্রটেকশন সেলের শীর্ষ পদে আছেন বি সি সোলাঙ্কি। তিনি একজন পুলিশ অফিসার। সুরক্ষা প্রত্যাহারের পর থেকে তিনি মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আর, এই লজ্জাবিহীন নোংরামির আবহে আতঙ্কিত শঙ্কিত সাক্ষী, অবসর নেওয়া বিচারক, আইনজীবী, কেউই বুঝে পাচ্ছেন না, তাঁদের কারও যদি কিছু হয়, তবে কে দায়ী থাকবে? কোর্ট, সিট, না কি গুজরাত পুলিশ?
আরও পড়ুন: দুয়ারে সরকার, জমা-পড়া আবেদনের অর্ধেক নিষ্পত্তি
এসবের প্রতি উদাসীন মোদি সরকার। বছরে দুকোটি বেকারের চাকরি, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম, জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, এসব ‘জুমলা’ প্রতিশ্রুতি বেবাক ভুলিয়ে দিতে তারা শুরু করেছে রামমন্দির উদ্বোধন নিয়ে উদ্দাম প্রচার। আত্মমুগ্ধ নরেন্দ্র মোদির কাট আউটে ছেয়ে ফেলা হয়েছে অযোধ্যা। বিশ্বে সর্বাধিক ক্ষুধার্ত দেশসমূহের অন্যতম ভারতের অর্থনীতি এখন অধোগতির ধারায় নিমজ্জিত। তার মধ্যেই অযোধ্যার নবনির্মিত রামমন্দির ঘিরে সরকারি কোষাগারের অর্থ জলের মতো খরচ হয়ে চলেছে।
২০০৮ থেকে ২০২৩, এই ১৫ বছরের মধ্যে দেশে সবথেকে বেশি বেকারত্বের হার বেড়েছে ২০২৩-এ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি-র সমীক্ষা বলছে, গত ১৫ বছরে বেকারত্বের হার ৫.১১ শতাংশ থেকে বাড়তে বাড়তে ২০২৩-এ ৮.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। করোনা অতিমারির সময়ের চেয়েও এবছর বেকারত্বের হার বেশি। বেকারি নিয়ে রিপোর্টে বিশ্বব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, ২০২৩-এ ভারতে বেকারির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.২২ শতাংশ। এই একই সময়ে পাকিস্তানে বেকারত্বের পরিমাণ ১১.৩ শতাংশ, বাংলাদেশে ১২.৯ শতাংশ, ভুটানে ১৪.৪ শতাংশ, ভারতের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই এই বেকারি হারে বিপুল বৃদ্ধি বলে জানানো হয়েছে।
এর মধ্যে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছে, তিন মাসে ফের মূল্যবৃদ্ধি সর্বাধিক হারে বেড়ে ২০২৩-এর নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৫ শতাংশে। গত অগাস্টে এটা ছিল ৬.৮৩ শতাংশ, তার পর থেকে তা নিম্নমুখী হয়েছিল। ফের তা ঊর্ধ্বমুখী।
এসবের মধ্যেই দুষ্কৃতীরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। আর বিচারক, সাক্ষী, আইনজীবীরা ভয়ে কাঁপছে। অদ্ভুত অবস্থা বিরাজ করছে চারদিকে।
জাস্ট মেনে নেওয়া যায় না।