মনে পড়ে কমরেড ২০১১-র কথা? নেতাই গ্রামে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী। রাজ্যের শাসকদল সিপিএম তখন অতি-বামেদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নেতাই গ্রামের প্রতি বাড়ি থেকে একজন সদস্যকে তাদের শিবিরে যোগদানের কথা বলেছিল। তার প্রতিবাদে গ্রামবাসীরা ৭ জানুয়ারি মিছিল করেন। সেই মিছিলেই গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। তাতে ৯ জন প্রাণ হারান ও ২৮ জন আহত হন।
আরও পড়ুন-ইনসাফ চাইছেন! বরং মুখ ঢাকুন লজ্জায়
লোকে বলে, সিপিএম মনে করত এবং আজও করে, নিজেদের সংগঠিত আন্দোলনগুলোই কেবল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, নিজেদের প্রভাবাধীন সম্মিলিত শক্তিই কেবল গণতান্ত্রিক শক্তি; আর বিরোধী শক্তিরাই ‘ঝামেলা, পথের কাঁটা, শ্রেণি শত্রু, অগণতান্ত্রিক, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, উন্নয়নবিরোধী৷’ অতএব, দাওয়াই মুগুর৷ আশির দশকে লাল ঝান্ডাকে ডান্ডা করে এসইউসিআই-সহ বিরোধীদের ট্রাম-বাসভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনকে দমন করার মধ্য দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তার পথ পরিক্রমা শেষ হয়েছিল নেতাই-কাণ্ডে বন্দুক দিয়ে প্রতিবাদরত গ্রামবাসীদের হত্যার মধ্য দিয়ে৷
আরও পড়ুন-আজ ভুবনেশ্বর-যাত্রা ক্লেটনদের, কুয়াদ্রাতকে ছাড়াই প্রস্তুতি ইস্টবেঙ্গলের
২০০৯-এর লোকসভায় বিপর্যয়ের পরেও দায়সারা ভাবে দোষ-ত্রুটিকে স্বীকার করার মানসিকতা দেখে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ ‘মাওবাদীদের’ দমনের নীতিও আদিবাসীদের সঙ্গে পার্টির দূরত্বকে বাড়িয়ে তুলেছিল৷ দলীয় মুখপাত্র তো পড়ার প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠেছিল৷ তার থেকেও মানুষের কাছে বড় হয়ে দেখা গিয়েছিল, তাদের অস্বীকারের রাজনীতির কৌশল গ্রহণ করা৷ সমস্ত ঘটনাকে অস্বীকার কর, প্রশাসনের যাবতীয় কুকর্মকে সমর্থন কর, তার পক্ষে সাফাই গাও, এবং অষ্টম বারে ক্ষমতায় এলে প্রতিশোধের হুঙ্কার দাও— এসব বিবৃতি মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল৷ নোয়াম চমস্কি, তারিক আলি, হাওয়ার্ড জিন, সুশান জর্জ প্রমুখ বাম মতাদর্শ ঘেঁষা বুদ্ধিজীবীরা ‘বাংলার বন্ধুদের’ উদ্দেশে লিখিত চিঠিতে কৃষকদের জমি রক্ষার আন্দোলনকে সংহতি জানিয়েছিলেন এবং বামপন্থী সরকারকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ আমরা জানি, আলোচনা তো দূরের কথা; কোনও ধরনের সদর্থক সমালোচনাকেই বামফ্রন্ট সরকার ও তার প্রবীণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুনতে রাজি ছিলেন না। এরকম একটা আবহেই ঘটে গেল নেতাইয়ের গণহত্যা।
প্রথমে নেতাই-কাণ্ডের তদন্ত করে সিআইডি। পরে ভার নেয় সিবিআই। সিপিএমের তৎকালীন জোনাল সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে-সহ সিপিএমের ২০ জন নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। তবে অনুজ ও তাঁর সম্পর্কিত ভাই ডালিম পাণ্ডে, রথীন দণ্ডপাট, জয়দেব গিরি, লব দুলে, চণ্ডী করণের মতো কয়েকজন অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান।
আরও পড়ুন-রাজ্যের বৃহত্তম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে চলেছে সাগরদিঘি, ২৫০০ কোটি টাকায় ৫ম ইউনিট
সেদিনকার কথাগুলো আরও একবার মনে করিয়ে দিই কমরেড। ঝাড়গ্রাম মহকুমার বিনপুর-১ ব্লকের লালগড় গ্রামপঞ্চায়েত। সেখানকার নেতাই গ্রামে সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি। অভিযোগ, এই বাড়িতেই সিপিএমের সশস্ত্র বাহিনী ক্যাম্প করেছিল। আর এই ক্যাম্পে থাকা লোকজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনকী নেতাই গ্রামের ছেলেদের নাকি অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে সে সময়। ক্যাম্পে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা বিরক্ত করে তুলতেন গ্রামের মহিলাদেরও। ওই যুবকদের যাবতীয় কাজকর্ম তাঁদের দিয়েই করানো হত বলে অভিযোগ ওঠে। মহিলাদের ওই ক্যাম্পে গিয়ে রান্না পর্যন্ত করে দিতে হত বলে অভিযোগ। এরপরই এলাকার মহিলারা প্রতিরোধে নামেন। গ্রামবাসীরা মুখের উপর বলে দেন, ওই সশস্ত্র বাহিনীর কোনও ফরমায়েস তাঁরা খাটবেন না। এই নিয়ে ঝামেলার সূত্রপাত। এরপরই গ্রামবাসীদের উপর ওই বাড়ি থেকে গুলি চালানো হয়।
এক যুগ কেটে গিয়েছে। নেতাইয়ের কল্পনা সেনরা সেদিনের কথা মনে করলে শিউরে ওঠেন আজও। তাঁর স্বামী দিলীপ সেনের চোখে, হাতে গুলি লেগেছিল। তিনি জানেন, সেদিনের অভিযুক্তদের অনেকেই জামিন পেয়েছেন। কল্পনার কথায়, ‘গ্রামে আসেন, দেখি তো। এখন তো ভয় করে।’
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বেই এগোবে দেশ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে পাল্টা ব্রাত্য-চন্দ্রিমার
ধরমপুরের যে সিপিএম জোনাল অফিস জ্বলে গিয়েছিল ‘গণরোষে’, সেই পার্টি অফিসের সামনে সিপিএমের ব্রিগেড অভিযানের সমর্থনে আগত মিছিলকে ফুল ছড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাতে দেখা গিয়েছে, নেতাই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ফুল্লরা মণ্ডলকে। এর আগেও বইমেলায় ফুল্লরাকে দিয়ে বইয়ের স্টল উদ্বোধন করিয়েছিল সিপিএমের ছাত্র সংগঠন। মহিলা সংগঠন বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে নিয়ে গিয়ে সভা করিয়েছিল। হার্মাদদের সামনে নিয়ে গণ আন্দোলনের জিগির তোলা যায়!
সত্যি বলছি। এতদিন জানতাম চক্ষুলজ্জা বলে একটা বস্তু আছে। এই ২০২৩-এ আর একবার টের পেলাম, ওই চক্ষুলজ্জা নামক কোনও বস্তু বঙ্গ সিপিএমের অভিধানে নেই।
হ্যাঁ কমরেড! কল্পনা সেনরা ইনসাফ চাইছেন। ওঁদের ইনসাফ দেওয়ার মুরোদ আছে আপনাদের?