গত ১৭ নভেম্ভের ২০২৩, শিল্পপূর্ব (১৮৫০-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ ) সময় থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেল। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ECMWF) সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই খবর পরিবেশন করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টার্গভেরমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ, সংক্ষেপে আইপিসিসি(IPCC) সতর্কবাণী দিয়েছিল যে ২০৩০ সালের আগে যেন বিশ্ব উষ্ণায়ন, শিল্প পূর্ব সময়ের থেকে ২ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডের বেশি বৃদ্ধি না পায় অর্থাৎ সীমাবদ্ধতার সতর্কবাণী সত্ত্বেও সাত সাল আগেই জলবায়ুর (Climate) জলাঞ্জলি হয়ে গেল।
বিশ্ব উষ্ণায়ন গতিবিধি
প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ থেকেই নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পৃথিবীর প্রাণীজগৎ বারংবার বিনষ্ট হয়েছে বা প্রগতির ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়েছে। মোটামুটি ভাবে মানব সভ্যতার বিকাশ শুরু ১১০০০ বছর আগে থেকে। এই সময়ের মধ্যে, মায়া সভ্যতা থেকে শুরু করে মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদরো-সহ পৃথিবীর নানা অংশে নানা সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে। এসমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের জীবনযাত্রার প্রভাব ছিল না। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হলেও, বস্তুত ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে শিল্পপূর্ব সময় বলে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০০ বছর সময়ে মাত্র ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বেড়েছে শিল্পপূর্ব সময় থেকে। আর ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২০ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, আইপিসিসি-সহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সতর্ক বাণী সত্ত্বেও ইসিএমআরডব্লুএফ-এর গণনা অনুযায়ী মাত্র ৩ বছরেরও কম সময়ে জলবায়ুর (Climate) জলাঞ্জলি দিয়ে লক্ষ্যমাত্রার ৭ বছর আগেই, গত ১৭ নভেম্বর ২০২৩ , শিল্পপূর্ব সময় থেকে ২ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড বেড়ে গেল। যেহেতু পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে ভূখণ্ড ও জনসংখ্যা দুই-ই বেশি, তাই উত্তর মেরুর তাপমাত্রা ভয়ানক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই কারণে অনেক বরফ ঢাকা অঞ্চল গলে জলে পরিণত হয়ে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। জলের তাপধারণ ক্ষমতা বেশি আর বরফের সূর্যের আলোর প্রতিফলন করার ক্ষমতা বেশি। এই দুই কারণে উত্তর মেরু সূচকীও ভরে আরও গরম হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- গাঁজা-কাণ্ডে কড়া শাস্তির দাবি
কেন সতর্কতা
এটি একটি ভয়ানক জটিল অবস্থা। কানাডার ম্যাক গিল ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট পরিবেশবিদ প্রফেসর লরেন্স মিসাক-এর মতে––
১) পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের নতি কোণ সব সময় ২৩.৪ হয় না। প্রিসিশন গতির জন্য উত্তর মেরু কখনও সূর্যের কাছে আসে, কখনও সূর্য থেকে দূরে সরে যায়। উত্তর মেরু এখন সূর্যের কাছে আসছে। তাই সৌরমণ্ডল ঘটিত উষ্ণায়ন আসছে।
২) আবার চাঁদের ঘূর্ণন গতির অক্ষের নতি কোণ ৫.২ এর মতো। তাই পৃথিবী এবং চাঁদের যুগ্ম নতি কোণ মোটামুটি ২৮ (২৩ + ৫) এবং ১৮ (২৩-৫) এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের জন্য জলস্তর নিচে চলে যেতে পারে, অথবা প্লাবন হতে পারে। আগে যে যে সভ্যতার বিলুপ্তির কথা বলা হয়েছে তার কারণ হিসাবে এগুলিই মনে করা হয়। বর্তমান পৃথিবী এবং চাঁদের যুগ্ম নতি কোণ ১৮ থেকে সামান্য বেশি । এই অবস্থায় সমুদ্রে প্লাবনের আশঙ্কা।
৩) এরপর শিল্প পরবর্তী উষ্ণায়ন (যা সম্পূর্ণ মানুষের হাতে), এই তিনের প্রভাবে অদূর ভবিষতে কী হতে পারে তা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নানাভাবে জানার চেষ্টা করছেন।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য যেমন কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে গাণিতিক সমীকরণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা, বায়ুর গতি ইত্যাদির মান, সময় ও স্থানের সাপেক্ষে বারবার অঙ্ক সমাধান করে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তেমনি ভবিষতে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধির অতি সংবেদনশীল গাণিতিক সমীকরণ আছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যেমন ১০ দিন পরের আবহাওয়া গণনা করে যায়, তেমনি আইপিসিসি-এর রিপ্রেজেন্টেটিভ কনসেন্ট্রেশন পাথওয়েস(সিআরপি) সমীকরণ ৪.৫, সমীকরণ ৮.৫ ইত্যাদি গণনা করে ২০০ বছর পরের জলবায়ুর (Climate) সম্বন্ধে বলতে পারে। এই সমীকরণগুলো বিশ্ব উষ্ণায়ন, সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল।
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব
এককথায় খুব শীঘ্রই পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির চেইন রিঅ্যাকশন শুরু হওয়ার মুখে। আইপিসিসি-এর সতর্কবাণী অনুযায়ী সমতলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০৩০-এর সাত বছর আগেই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি হওয়াতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আরও বাড়বে। বিষুবরেখা বরাবর উলম্ব গতি সম্পন্ন(ওয়াকার সার্কুলেশন) ও অনুভূমিক গতিসম্পন্ন (রসবি ওয়েভ) তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। এই তরঙ্গগুলিই মৌসুমী বায়ুর স্থান-কাল নির্ণয় করে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে এই তরঙ্গ গতি বিঘ্নিত হবে। ফলস্বরূপ বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও নানা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্ত বাড়বে। বিমান ও জাহাজের ওজন উত্তোলন ক্ষমতা কমে যাবে, সঙ্গে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিবহণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ সহ সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে। আগ্নেয়গিরির প্রভাব, ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবে, কাজের দিন কমে যাবে,অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল রাজ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
প্রতিকার
আরও আরও গাছ লাগাতে হবে। যুদ্ধ বন্ধ করতেই হবে। সারা পৃথিবীতে ব্যাপক হারে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হব। পরিবেশবান্ধব করে নতুন নতুন প্রশস্ত রাস্তা সমেত শহর নির্মাণ। পরিবহণ জ্যামমুক্ত সুগম করতে হবে। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বাড়াতে হবে, প্রত্যেক গাড়িতে সোলার সেল ব্যবহার করতে হবে, ব্যক্তিগত যানবাহনে সীমাবদ্ধতা আনতে হবে। পণ্য পরিবহণে জাহাজে ইঞ্জিনের সঙ্গে সঙ্গে পালের ব্যবস্থা করতে হবে। বায়ু (Climate) ও সমুদ্র জলের গতি অনুযায়ী জাহাজ চালাতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা কমাতে হবে।