ফ্লেমিং-এর গুচ্ছ নীহারিকা

আমরা মানুষ জাতি, এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব, তাই আমাদের মধ্যে পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করতে বৈজ্ঞানিক কসরতের শেষ নেই; উঠে-পড়ে লেগেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দল এবং সেই কর্মযজ্ঞে যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ফ্লেমিং-এর ত্রিভুজাকৃতি গুচ্ছ নীহারিকা সাক্ষ্য দিচ্ছে। লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’

সত্যিই তো রবি ঠাকুরের মতো উন্নত মস্তিষ্কসম্পন্ন গোটা মানবজাতির কাছেও বড়ই রোমাঞ্চকর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও তার সৃষ্টির গল্পগাথা। এই পৃথিবী সৃষ্টি হল কীভাবে! আর কীভাবেই বা এই পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হল! এই নিয়ে গোটা মানবজাতির বড়ই ব্যস্ততা। বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম সৃষ্টির ইতিহাস জানতে এবং নতুন সৃষ্টির খোঁজে সাধারণ মানুষের জ্ঞানপিপাসা মেটানোর চেষ্টায় সতত মগ্ন।

প্রচলিত ধারণা
আজও মনে করা হয়, সৌরজগৎ সৃষ্টির মোটামুটি ১০০ মিলিয়ন বছর পর একগুচ্ছ মহাজাগতিক সংঘর্ষের ফল হল পৃথিবী। আজ থেকে প্রায় ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের গ্রহটি আকৃতি পায়, পায় লৌহের একটি কেন্দ্র, সমুদ্র এবং একটি বায়ুমণ্ডল। ওই মহাকাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্যাসীয় মেঘ যা বিজ্ঞানের পরিভাষায় সৌর-নীহারিকা বলে চিহ্নিত, সেগুলো মহাকর্ষীয় প্রভাবে বিভিন্ন নৈসর্গিক উপাদান একত্র করে ঘনীভবন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভরের পরিবৃদ্ধি ঘটিয়েছে; ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি সৌরজগৎ, সূর্য ও পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য গ্রহ। তবে ওই বিচিত্র ব্রহ্মাণ্ডে তারা, গ্রহাণু, জ্যোতিষ্ক প্রভৃতির জন্ম-মৃত্যু লেগেই রয়েছে; এর কারণ ‘সুপারনোভা’, যা আসলে একটি বিধ্বংসী মহাকাশ ঝঞ্ঝা! গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় পঞ্চাশ বছর অন্তর অন্তর ওই মহাশূন্যে বৃহত্তর নক্ষত্রগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ উচ্চ তাপ ও চাপের প্রভাবে গগনভেদী বিস্ফোটন ঘটায়; মৃত্যু হয় একটি বিশাল নক্ষত্রের; জন্ম নেয় নতুন নতুন শিশুনক্ষত্র! ঠিক এভাবেই জন্ম নিয়েছে ফ্লেমিং-এর গুচ্ছ নীহারিকা (Nebula)।

সাম্প্রতিক আলোড়ন
গত ২১ নভেম্বর নাসার গোডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের অ্যাস্ট্রোফিজিক্স সায়েন্স ডিভিশন ফ্লেমিং-এর ত্রিভুজাকৃতি গুচ্ছ নীহারিকার একটি মনোগ্রাহী ছবি প্রকাশ করে মহাজাগতিক সৃষ্টি ও ধ্বংসের রোমাঞ্চকর কাহিনিটিকে একপ্রকার পুনরুজ্জীবিত করেছে। ওই গুচ্ছ নীহারিকার ছবিটি তুলেছেন অ্যাস্ট্রোবিন নামে একটি আন্তর্জালিক মহাকাশ-চিত্রশালার বৈজ্ঞানিক চিত্রগ্রাহক ক্রিশ্চিয়ানো গুয়ালকো। ছবিটি দেখে আমরা সকলেই হতবাক! জ্বলন্ত গ্যাসের কিছু বিশৃঙ্খল এবং জটযুক্ত ফিলামেন্ট একটি ভেইল নেবুলা বা পর্দা নীহারিকার অংশ হিসাবে সিগনাস নক্ষত্রের দিকে পৃথিবীর আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রদীপ্ত ফিলামেন্টগুলি সত্যিই প্রায় প্রান্তে দেখা যায় এমন একটি পর্দার লম্বা লহরের মতো, যা সালফারের লাল এবং অক্সিজেনের নীল রঙে আয়নিত হাইড্রোজেন পরমাণুর সবুজ আভাতে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা। এই ত্রিভুজাকৃতি গুচ্ছের আনুমানিক দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ আলোকবর্ষের সমান এবং পৃথিবী থেকে এর আনুমানিক দূরত্ব ২৪০০ আলোকবর্ষ।

ভেইল নেবুলা
আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে, নথিভুক্ত মানবসভ্যতার ইতিহাসের সূচনাকালের পূর্বে, ওই আকাশে একটি নতুন আলোর ঝলকানি দেখা গিয়েছিল, কয়েক সপ্তাহ পরে সেই আলোটি হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেল। সেদিন আমরা অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিলাম শূন্যের পানে। বুঝিনি কিছুই, তবে আজ বুঝেছি, ওটা ছিল সুপারনোভায় সৃষ্ট নতুন তারার আলোকপ্রভা! সেদিনের সেই বিস্ফোটিত তারার বিস্তৃত নুড়ির পাতলা মেঘই আজকের ভেইল নেবুলা বা পর্দা নীহারিকা (Nebula)।
ভেল নেবুলা নিজেই একটি বৃহৎ সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ, একটি প্রসারিত মেঘ যা একটি বিশাল নক্ষত্রের মৃত্যু-বিস্ফোরণ থেকে জন্ম নিয়েছে। মূল সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে আলো সম্ভবত ৫০০০ বছর আগে পৃথিবীতে পৌঁছেছিল। এই নীহারিকাটি আকাশের প্রায় ৩ ডিগ্রি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত, আকারে বৃত্তাকার, সিগনাস দ্য সোয়ান তারামণ্ডলের কাছেই এর অবস্থান। সেই জন্যই এই নীহারিকাটি সিগনাস লুপ নামেও পরিচিত। মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি এনজিসি ৬৯৭৯ হিসাবে তালিকাভুক্ত, ভেইল নেবুলা এখন পূর্ণ চাঁদের ব্যাসের প্রায় ৬ গুণ বিস্তৃত। সিগনাস তারামণ্ডলের নিকট গ্যাসীয় মেঘজটলায় উপস্থিত সালফারের জন্য লাল, হাইড্রোজেনের জন্য সবুজ ও অক্সিজেনের জন্য নীল রঙের উজ্জ্বল ফিলামেন্টের এই কোমল জালবিন্যাসই আসলে ভেইল নেবুলা বা পর্দা নীহারিকা। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই নীহারিকাটির মূলত তিনটি অংশ, যথা— ব্যাট নেবুলা বা বাদুড় নীহারিকা, উইচ্স ব্রুম নেবুলা বা ডাইনির ঝাঁটা নীহারিকা এবং ফ্লেমিংস ট্রায়াঙ্গুলার উইস্প নেবুলা বা ফ্লেমিং-এর ত্রিভুজাকৃতি গুচ্ছ নীহারিকা।

আরও পড়ুন- জন্মবার্ষিকীতে নেতাজিকে শ্রদ্ধা অভিষেকের

বৈজ্ঞানিক খোঁজ
ভেইল নেবুলার প্রদত্ত ছবিটিতে স্পষ্টতই দৃশ্যমান, এই নীহারিকার (Nebula) পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল, মধ্যভাগ অনেকটাই ঘোলাটে কাঠামোর এবং দক্ষিণ প্রান্ত যেন মাকড়সার জালের মতো। এই অবস্থানের ঠিক উজ্জ্বল দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকেই বলা হয় ফ্লেমিংস ট্রায়াঙ্গুলার উইস্প নেবুলা। এটি সম্ভবত এর আবিষ্কারক জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়ামানা প্যাটন স্টিভেন্স ফ্লেমিংয়ের নামানুসারে এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে। তবে বিজ্ঞানী মহলে এই নীহারিকাটি পিকারিংস ট্রায়াঙ্গল নামেও পরিচিত। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অন্তর্গত হার্ভার্ড কলেজ অবজারভেটরির ডিরেক্টর এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিং-এর নামানুসারে এই নামকরণ।
উইলিয়ামিনা প্যাটন স্টিভেন্স ফ্লেমিং একজন স্কটিশ সিঙ্গেল মাদার; তিনি মহাকাশ গবেষণা বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন; তাঁর কর্মনিষ্ঠা দেখে হার্ভার্ড কলেজ অবজারভেটরির ডিরেক্টর এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিং তাঁর স্ত্রীর পরামর্শে উইলিয়ামানা ফ্লেমিংকে গবেষণার কাজে নিয়োগ করেন। তাঁর প্রধান কাজ ছিল প্রতিটি নক্ষত্রের বর্ণালিগত তারতম্যের উপর ভিত্তি করে সেই সমস্ত নক্ষত্রের চিত্রগত শ্রেণিবিন্যাস করা। ফ্লেমিং তাঁর কর্মজীবনে দশ হাজারের বেশি নক্ষত্র, ৫৯টি গ্যাসীয় নীহারিকা, ৩১০টি ভ্যারিয়েবল তারা এবং আরও ১০টি নোভা বা নতুন নক্ষত্রের একটি সাধারণ শ্রেণিবিন্যাস সূচিতে নথিভুক্ত করেন। তিনি মূলত ১৮৮৮ সালে হর্সহেড নেবুলা আবিষ্কারের জন্য স্বনামধন্য।
তিনিই এই গুচ্ছ নীহারিকা আবিষ্কার করলেও প্রাথমিক ভাবে দানিশ জ্যোতির্বিদ জন লুই এমিল ড্রেয়ারের ১৮৮৮ সালে তৈরি মহাজাগতিক বস্তুর সাধারণ সূচিতে এটি ‘পিকারিংস ট্রায়াঙ্গল’ হিসেবেই পরিচিত ছিল। এই অবিচারের জন্য বিজ্ঞানী মহলে জোর সমালোচনা হয়। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত এই ‘দ্য নিউ জেনারেল ক্যাটালগ অব নেবুলে অ্যান্ড ক্লাস্টারস অব স্টারস (এনজিসি)’ বইয়ে ছায়াপথ, স্টার ক্লাস্টার ও নির্গমন নীহারিকার মতো মোট ৭৮৪০টি মহাজাগতিক বস্তুর নথিভুক্তকরণ হয়। পরবর্তীতে ১৯০৮ সালে এই সূচি আরও ৫৩৮৬টি বস্তুর সংযোজন-সহ ‘ইনডেক্স ক্যাটালগস (আই সি)’ নামে প্রকাশিত হলে, এই সূচিতে এই গুচ্ছ নীহারিকার নাম হয় ফ্লেমিংস ট্রায়াঙ্গুলার উইস্প নেবুলা। বর্তমানে এই গুচ্ছ নীহারিকাই নিসর্গবিদদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে; আর চড়িয়ে দিয়েছে আমাদের কৌতূহলের পারদ; মহাকাশকে নতুন করে আবিষ্কারের আশায়!

Latest article