ঋত্বিক ঘটক এবং অর্ধেন্দু সেন। দুই বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক। প্রথমজন আজও চর্চায়। দ্বিতীয়জন থেকে গেছেন অন্তরালে। এই মাসেই তাঁরা পাড়ি দিয়েছিলেন না-ফেরার দেশে। ৬ ফেব্রুয়ারি ঋত্বিক ঘটক, ৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধেন্দু সেন। তাঁদের স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী
থেকে যাবেন ঋত্বিক
বাবা চেয়েছিলেন ছেলে হোক ‘ইনকাম-ট্যাক্স অফিসার’। সেইমতো ছেলে নেন প্রস্তুতি। পেয়েও যান চাকরি। তবে বেশিদিন করেননি। একদিন ছেড়ে দেন কাজ। বেছে নেন অন্য জীবন। হাতছানি দেয় শিল্প, সাহিত্য। মেতে ওঠেন সৃষ্টিশীল কাজে। তিনি ঋত্বিক ঘটক। আজীবন হেঁটেছেন ভঙ্গুর পথে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। তবু এগিয়েছেন। মাথা উঁচু করে।
জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর। বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার জিন্দাবাজারে। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক, মা ইন্দুবালাদেবী। বাবা পেশায় ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বদলির চাকরি। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেফিরে অবসরের পর রাজশাহিতে থিতু। ঋত্বিকের শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে রাজশাহিতে। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। সেখানকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, পরে রাজশাহি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ।
বাড়িতে ছিল সাহিত্য সাংস্কৃতিক ধারা। লেখালিখির শুরু ছাত্রাবস্থায়। প্রকাশ করতেন ‘অভিধারা’ নামের একটি পত্রিকা। নিজের লেখা ছোটগল্প ‘অয়নান্ত’ ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাড়ি থেকে দু’-তিনবার পালিয়েছেন। কানপুরে একটা টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্টেও কাজ করেছেন কিছুদিন। শেষে ১৯৪২ সালে, কানপুর থেকে বাড়ির লোকজন ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। মাঝখানে দু’বছর পড়াশোনা থেকে দূরে ছিলেন। যদিও পরে তাঁর পড়াশোনায় মন আসে।
বড়দা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের নাম করা কবি। সেই সুবাদে বাড়িতে একটা অন্যরকম পরিবেশ ছিল। বাড়িতে আসতেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়রা। ঋত্বিক তাঁদের কথা শুনতেন। অনুপ্রাণিত হতেন। ১৯৪৮ সালে লিখলেন প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’। ওই বছরেই বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘নবান্ন’ নাটকে অভিনয় করেন। ‘কলঙ্ক’ নাটকে অভিনয় করেন উৎপল দত্তের সঙ্গে। ১৯৪৯ সালে নিজের নাটকের দল গড়েন ঋত্বিক, ‘নাট্যচক্র’। সেখানে নীলদর্পণ নাটকে অভিনয়ও করেন। এরপর পরিচালনা। নাটক ‘ঢেউ’, ‘জ্বালা’, ও ‘ম্যাকবেথ’।
মেজদা সুধীশ ঘটক ছিলেন ‘টেলিভিশন এক্সপার্ট’। তিনি গ্রেট ব্রিটেনে ডকুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান হিসেবে ৬ বছর কাজ করেন। পরে নিউ থিয়েটার্সে যুক্ত হন। বহু উল্লেখযোগ্য ছবিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাননবালা-সায়গলের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। বাড়িতে আসতেন চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্টরা। আড্ডা চলত দীর্ঘক্ষণ। ঋত্বিকও যোগ দিতেন। দেখতেন ওঁদের ছবি। আকৃষ্ট হতেন। এইভাবেই ধীরে ধীরে একদিন চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শুরুর দিকে কাজ করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-এ অ্যাসিস্ট করার পাশাপাশি অভিনয়ও করেন। একক ভাবে তাঁর প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’। তৈরি হয় ১৯৫২ সালে। আর্থিক কারণে ঋত্বিকের জীবদ্দশায় ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৭৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিউ এম্পায়ারে ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৮ সালের মে মাসে মুক্তি পায় ‘অযান্ত্রিক’। সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চলচ্চিত্রে এসেছিলেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। একসঙ্গে লক্ষ মানুষের কাছে নিজের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সারা জীবন ভেবেছেন মানুষের জন্য। মানুষের হয়েই কথা বলেছে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি।
খুব বেশি ছবি করেননি। তবে ঋত্বিক ঘটকের মুক্তিপ্রাপ্ত সব ছবিই সাড়া ফেলেছিল। দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছিল ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৯), ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১), ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২), ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশে তাঁর তৈরি ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালে নির্মিত তাঁর শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, তিন বছর পর ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে মিনার-বিজলি-ছবিঘরে মুক্তি পায়।
ছবি পরিচালনার পাশাপাশি মুম্বইয়ে হিন্দি চিত্রনাট্য রচনার কাজও করেছিলেন। বিমল রায়ের ছবি ‘মধুমতি’র চিত্রনাট্যকারও ছিলেন তিনি। ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ বেশ কিছুদিন পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ভাইস-প্রিন্সিপাল পদে কাজ করেছেন।
১৯৫৫ সালের ৮ মে বিয়ে করেন। স্ত্রী সুরমা ঘটক ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। নবদম্পতি প্রথমে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে থাকার পরে ‘বোম্বে’র গোরেগাঁওয়ের একটি ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিলেন। তাঁদের দুই কন্যা— সংহিতা ও শুচিস্মিতা এবং একমাত্র পুত্র ঋতবান।
একটা সময় পর্যন্ত জীবনে ছিল ছন্দ। তারপরে ঘটে যায় ছন্দপতন। বেপরোয়া, অস্বাভাবিক যাপন শুরু করেন ঋত্বিক। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কেরিয়ার, জীবন। অনেকেই মনে করেন, যতটা প্রতিভা ছিল, ততটা কাজে লাগাননি। হয়তো ইচ্ছা করেই। প্রকৃত কারণ যে কী, সেটা অজানা। তবে তাঁর বিস্ময় প্রতিভাকে অস্বীকার তখনও করা যায়নি, আজও করা যায় না। তাঁর ছবি সময়ের কথা বলে। শিক্ষা দিয়ে যায়। অন্যকে অনুসরণ করেননি কোনওদিন। যা কিছু সৃষ্টি করেছেন আপন খেয়ালে। স্বাভাবিক গতিতে। মানেননি ছবি তৈরির ব্যাকরণ।
দীর্ঘদিন লিভারের সমস্যায় ভুগছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। সাড়ে চার দশক তিনি নেই। তবু তিনি তুমুলভাবে আছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে। আজও মেধাবী বাঙালির আড্ডার আসরে তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়। তুলনা হয় আরও দুই কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের সঙ্গে। এইভাবেই তিনি আছেন। থাকবেন। থেকে যাবেন।
তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেন
গৌতম ঘোষ
আমি জানি না এখনকার প্রজন্ম ঋত্বিক ঘটককে কতটা মনে রেখেছে। উনি এমন সমস্ত কাজ করে গেছেন যেগুলো চিরস্থায়ী হবে বলে আমার ধারণা। ঋত্বিকদাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। খুব স্নেহ করতেন। ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরির প্রোজেকশনে আমার ‘হাঙরি অটাম’ ডকুমেন্টারির স্ক্রিনিং দেখাই। বেরিয়ে এসে আমার পশ্চাদ্দেশে একটা লাথি মেরেছিলেন। তখন আমার ২৪ বছর বয়স। আমি তো ঘাবড়ে গেছি। বললেন,‘‘তুই ফাটিয়ে দিয়েছিস, ব্যাটা।’’ এটা আসলে ওঁর ভালবাসা। একেবারে উদ্দাম।
ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় একসঙ্গে আড্ডা মারতেন। প্যারাডাইস কাফেতে। ছবি নিয়ে আলোচনা হত, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হত। ঋত্বিকদার থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। পাশাপাশি সাহিত্যের ব্যাকগ্রাউন্ড। সেইসঙ্গে সিনেমা। ওঁর সিনেমা ছিল খুব পার্সোনাল। সমস্ত স্ট্রাকচার, ট্রিটমেন্ট দেখে বোঝা যায় এটা ঋত্বিক ঘটকের ছবি। নতুন প্রজন্মের উচিত ওঁর ছবি বারবার দেখা। অনেক কিছু শেখার আছে।
তিনি যে সমস্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সেগুলো সময়ের দলিল। চিরকাল মনে রাখার মতো। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তাঁর ছবি দেখলে সেটা ভালমতো বোঝা যায়। মাঝে মাঝে এমন কিছু করেছেন, যেটা দেখে লোকেরা বলেছেন, ওভার ড্রামাটিক। থিয়েট্রিক্যাল। আসলে ওটা নিজের মতো করে করেছেন। পরবর্তীকালে বারবার দেখলে মনে হয় যে, একটা বিশেষ অনুসঙ্গ রয়েছে যেটা আমাদের ধাক্কা দেয়। বারবার মনে করিয়ে দেয়।
‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে বিজন ভট্টাচার্য বলে ওঠেন ‘একটি বীভৎস মজা’। কথাটা আমাদের কানে বারবার বাজতে থাকে। কোনওদিন ভুলব না আমরা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক সমসাময়িক ছিলেন। এক দুই বছরের ছোট-বড়। মোটামুটি একই সময়ের মানুষ। ঋত্বিক ঘটকের শতবর্ষ আসছে। তিনি অনেক কিছু দেখেছেন। তেতাল্লিশের মন্বন্তর, হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, দেশভাগ। বারবার দেশভাগের প্রসঙ্গ ওঁর ছবিতে এসেছে। আমার মনে হয় ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে একটা ম্যাজিক ছিল। সেই সিনেমার ম্যাজিক চিরকাল থাকবে। ওঁকে আমরা স্মরণ করি। তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেন। সব সময়। বলতেন, কখনও কম্প্রোমাইজ কোরো না। একই কথা বলতেন মৃণাল সেনও। এই ব্যাপারটা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।
সঠিক মূল্যায়ন হয়নি ঋত্বিক ঘটকের
অম্লানকুসুম ঘোষ
সাত-আটের দশকে আমরা তখন পরিণত বয়সের দিকে যাচ্ছিলাম। কৈশোর থেকে যৌবন। সেই সময়টা ভয়ঙ্কর উত্তাল সময় ছিল। সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন ভীষণভাবে উথালপাতাল হচ্ছিল। তার পেছনে ছিল দুটো কারণ, নকশাল মুভমেন্ট এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ। ঋত্বিক ঘটক তার অনেক আগেই ছবি করতে শুরু করেছেন। পাঁচের দশকে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র আগেই তৈরি করেছিলেন ‘নাগরিক’। যদিও ছবিটা রিলিজ করেছিল অনেক পরে। বলা যায় ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, এঁদের মোটামুটি একই সময় চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ। শুধু ভারত বা বাংলা নয় এই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঋত্বিক ঘটককে জেনেছি সাত-আটের দশকে। সেই সময় আমাদের বোধটা জানার মতো পরিণত হচ্ছিল। তখন খুব প্রাসঙ্গিক মনে হত। ভারত এবং বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের যে উথালপাতাল, ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে দারুণ ভাবে তা ফুটে উঠেছিল। গোদারের দ্বারা দারুণ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ভিয়েতনামের যুদ্ধ বড় অবসেশন ছিল গোদারের, ঋত্বিক ঘটকের অবসেশন ছিল দেশভাগ। কোনও একজন ঋত্বিক ঘটককে বলেছিলেন, তোমাকে তিনটে জিনিস খেল। মা, দেশভাগ এবং রবীন্দ্রনাথ।
আমার একটা কথা মনে হয়, সঠিক মূল্যায়ন হয়নি ঋত্বিক ঘটকের। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র সমালোচনার দিকটায় খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিচ্ছিন্নভাবে সমালোচক এসেছেন। হাতেগোনা। বেশিরভাগ সমালোচক সিনেমার গল্প বলেন। গভীরে যান না। ফলে ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা অনেকটাই আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। তাঁর ছবির সমালোচনা করার ক্ষমতা খুব বেশি সমালোচকের ছিল না। ফ্রান্সে নিউওয়েভ মুভমেন্টের আগে গোদার এবং তাঁর সতীর্থ সমালোচকরা যেটা পেরেছিলেন, আমাদের দেশে কিন্ত সামগ্রিক ভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। তাই নানা কারণে ঋত্বিক ঘটক আজও আন্ডাররেটেড; অবহেলিত।
অল্প কিছুদিন আমি এফটিআই পুণেতে ছিলাম। সেখানে দেখেছি ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে মানুষের কত আগ্রহ, কত প্রভাব নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের মধ্যে। তাঁর স্মৃতি আজও এফটিআইয়ের বাতাসে ম-ম করে। তিনি মাত্র কিছুদিন ওখানে শিক্ষকতা করেছেন। ঋত্বিক ঘটক ভারতীয় চলচ্চিত্রে চিরস্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছেন। সেটা মুছে ফেলার ক্ষমতা কারও হবে না। তিনি বাস্তবতার মধ্যে থেকেও মনকে পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যেতে পারতেন। অসামান্য প্রতিভা ছিল তাঁর। এই প্রতিভা ঘরে বসে চিন্তা করে হয় না। এটা তাঁর মজ্জাগত ছিল। আত্মহনন তাঁকে একটা মিথে পরিণত করেছিল। আমরা বাংলায় একটা ধারা জানি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামকিঙ্কর বেইজ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ধারা। ঋত্বিক ঘটকও ছিলেন সেই ঘরানার মানুষ। এঁরা প্রত্যেকেই মিথ হয়ে গেছেন আত্মহননের জন্য। যদিও আত্মহনন আমরা বাইরের মানুষরা দেখছি। এই আত্মহনন কিন্তু তাঁদের সমৃদ্ধ করেছে। শিল্প সৃষ্টি এবং পাটোয়ারি বুদ্ধির মধ্যে একটা বৈরিতা আছে। পাটোয়ারি বুদ্ধি থেকে এঁরা অনেকটা দূরে থাকায় অসাধারণ সব সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ঋত্বিক ঘটক অনেকের দ্বারা প্রভাবিত হলেও, ভারতীয়ত্বের যে শিকড়, সেই শিকড় ছেড়ে কখনও কোথাও যাননি। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ দেখলে বুঝতে পারি, ‘সুবর্ণরেখা’ দেখলে বুঝতে পারি। ভারতীয় সনাতনী বোধ, সাংস্কৃতিক পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন হননি কখনও। তাঁর ছবিতে আমরা পাই মাটির সোঁদা গন্ধ। এই যে বহুধাবিস্তৃত তাঁর বোধ, সেই বোধটাই তাঁকে বারবার সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর ছবি সমৃদ্ধ হয়েছে। আমরাও সমৃদ্ধ হয়েছি। দর্শক হিসেবে এবং সিনেমার কর্মী হিসেবে।
ঋত্বিক ঘটক একটা দর্শন
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
স্কুলে পড়ার সময় আমি প্রথম ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা দেখি। নন্দনে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। দেখেছিলাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’। তার আগে বাড়িতে ঋত্বিক ঘটক নিয়ে আলোচনা শুনতাম। সব যে বুঝতাম, তা কিন্তু নয়। জেনেছিলাম, পূর্ব বাংলার প্রতি তাঁর গভীর টান, দেশভাগের যন্ত্রণা তাঁকে কুরে কুরে খায়। তখন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে আমার মনে হয়েছিল, অন্য ধরনের ভাষা, অন্য ধরনের লেখা। ভীষণ রক্তমাংসের।
সিনেমার জগতে আসার পর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই বলতেন, আমাকে নাকি অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেখতে। অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঋত্বিক ঘটকের অন্যতম পছন্দের অভিনেতা। ১৯৯৬ সালে একটা ছবি হয়েছিল, ‘দ্য নেম অফ এ রিভার’। বাংলায় ‘একটি নদীর নাম’। অনুপ সিং ছিলেন পরিচালক। ওটা ছিল ঋত্বিক ঘটকের জীবনের উপর ডকু ফিচার। নায়কের ভূমিকায় ছিলাম আমি। সেই কাজ করতে গিয়ে ঋত্বিকবাবুর প্রায় প্রত্যেকটি সিনেমা দেখতে হয়েছিল। বোঝার চেষ্টা করেছিলাম ওঁর সিনেমাদর্শন। একটা টিম দীর্ঘ সময় ধরে করেছিল রিসার্চ। তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এমন কয়েকজন, যাঁদের ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী-সহ অনেকেই। বিভিন্ন সময় ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা তৈরি হয়েছে কলকাতার রাস্তা, সুবর্ণরেখা নদী, আদিবাসী গ্রাম, কালিম্পং, কার্শিয়াং, বাংলাদেশ, পদ্মাপাড়ে। আমরা প্রায় সমস্ত জায়গায় গিয়েছিলাম। ক্যামেরা করেছিলেন কে কে মহাজন। দারুণ অভিজ্ঞতা। যাত্রার প্রতি ছিল ঋত্বিক ঘটকের দুর্বলতা। আমাদের ছবিতে যাত্রাও ছিল। যাপনের মধ্যে দিয়ে বুঝেছিলাম, ঋত্বিক ঘটক একটা দর্শন। একটা বিজ্ঞান। চলচ্চিত্রের পড়ুয়াদের ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে জানা আবশ্যক। তাঁর সিনেমার পাগলামো তাঁদের আকৃষ্ট করে। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রের কোনও ব্যাকরণ মানেননি। স্বাধীন শিল্পী হিসেবে যেটা বলতে চেয়েছেন, সেটাই বলেছেন।
অন্তরালে অর্ধেন্দু
পাঁচের দশক বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ। তৈরি হয়েছে একটার পর একটা রুচিশীল ছবি। সঙ্গে অসাধারণ গান। বাণিজ্যিক ছবির ধারায় তখন চুটিয়ে কাজ করছেন কয়েকজন দক্ষ পরিচালক। সেই সময় একজন পরিচালক কিছুটা নীরবে তৈরি করে গেছেন সাহিত্য-নির্ভর একাধিক বাংলা ছবি। তিনি অর্ধেন্দু সেন।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর পরিচালিত ‘হ্রদ’। বিমল করের উপন্যাসের প্রথম চিত্ররূপ। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার, সন্ধ্যারানি, ছবি বিশ্বাস, জহর রায়, অসিত বরণ, তরুণ কুমার প্রমুখ। শ্যামল গুপ্তর কথায় সুরারোপ করেছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। জনপ্রিয় হয়েছিল গানগুলো। রূপমায়া প্রযোজিত সাদাকালো ছবিটি দর্শকরা দেখেছিলেন দর্পণা, ছায়া, পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে। উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন এক মানসিক ভারসাম্যহীনের চরিত্রে। এই ছবিতে অভিনয় করেই প্রথমবার তিনি পেয়েছিলেন সেরা অভিনেতার বিএফজেএ পুরস্কার। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, এই ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তরুণকুমার। তখন তিনি থিয়েটার করতেন। মঞ্চে অভিনয় দেখে তাঁকে নিজের ছবিতে সুযোগ দিয়েছিলেন অর্ধেন্দু। পরিচালনার পাশাপাশি ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। দর্শক এবং সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল ছবিটি। গল্পের মধ্যে ছিল দারুণ ট্যুইস্ট।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে ১৯৫৭ সালে অর্ধেন্দু তৈরি করেন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। ছবিটি বাণিজ্যিক ভাবে দারুণ সাফল্য পেয়েছিল। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, সন্ধ্যারানি, ছবি বিশ্বাস, অনুপ কুমার, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, জহর রায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী।
১৯৭২ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘মা ও মাটি’। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অসিত বরণ, রবি ঘোষ, অজিত চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ছবিটি বাণিজ্যিক ভাবে ততটা সাফল্য না পেলেও, পেয়েছিল সমালোচকদের প্রশংসা। অর্ধেন্দু সেন পরিচালিত ‘পরিশোধ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়। এই ছবি দিয়েই চলচ্চিত্রে অভিনয় জীবন শেষ করেছিলেন নরেশ মিত্র। তাঁকে দেখা গিয়েছিল মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বাবার চরিত্রে।
‘সুশান্ত সা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ছায়াদেবী, লিলি চক্রবর্তী প্রমুখ। সেই সময় দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি। এ ছাড়াও ‘ধুলার ধরণী’, ‘পরের ছেলে’, ‘সিঁথির সিঁদুর’ তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি।
খুব অল্প ছবি তৈরি করেছেন। প্রতিটি ছবিতেই দেখা যায় রুচিশীলতার ছাপ। দিয়ে যায় কোনও না কোনও বার্তা। ১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন অর্ধেন্দু সেন। আজ এই পরিচালক বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। তাঁকে নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয় না।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্বাধীনতা দিতেন
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
অর্ধেন্দু সেন পরিচালিত সিনেমায় আমি অভিনয় করেছি। তখন সাদাকালো ছবির যুগ। বহু বছর আগের কথা। শুটিংয়ের সব ঘটনা আজ মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, উনি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিতেন। দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়ে বলতেন নিজেদের মতো করতে। ফলে আমাদের খুব সুবিধা হত। সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের বাড়িতে এসেছেন বেশ কয়েকবার। একটা সময়ের পর যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। আজ তিনি নেই। তবে কাজের মধ্যে দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন।
দূর থেকে দেখতাম অর্ধেন্দুবাবুকে
হরনাথ চক্রবর্তী
পরিচালক অর্ধেন্দু সেন ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। সুদর্শন এবং সুভদ্র। আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে তখন নতুন। তিনি আসতেন। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয়। ওখানে সম্ভবত ওঁর অফিস ছিল। বসতেন ক্যানটিনেও। সারাক্ষণ হত সিনেমা নিয়ে আলোচনা। বহু পরিচালক উঠে এসেছেন ওই ক্যান্টিন থেকে। দূর থেকে দেখতাম অর্ধেন্দুবাবুকে। কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি কোনওদিন। স্টুডিওয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, অন্যান্য পরিচালক থেকে টেকনিশিয়ান, প্রত্যেকেই ওখুব সম্মান করতেন। অসাধারণ সব ছবি করেছেন। উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন ওঁর ‘হ্রদ’ ছবিতে। ছবিটি এক কথায় ক্লাসিক। সবথেকে দুঃখের কথা পাঁচের দশকের এই পরিচালকদের আমরা আর কেউ সেই ভাবে মনে রাখি না। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ প্রমুখদের নিয়ে যত চর্চা হয়, তত চর্চা হয় না অর্ধেন্দু সেন, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, অজয় কর প্রমুখ পরিচালকদের নিয়ে। অথচ একটা সময় ইন্ডাস্ট্রিকে এঁরাই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আমি আশা করব নতুন প্রজন্ম অর্ধেন্দু সেনের ছবি দেখবেন, তাঁকে নিয়ে আলোচনা করবেন। এঁদের ছবি দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। আমি তো শিখেছি এঁদের দেখেই।
তিনি আজ বিস্তৃতপ্রায়
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
পাঁচের দশকের বিশিষ্ট পরিচালক অর্ধেন্দু সেন। তিনি আজ বিস্তৃতপ্রায়। কেউ তাঁকে আজ মনে রাখেননি। অথচ মহানায়ক উত্তমকুমার, ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ছবিতে অভিনয় করেছেন।
একজন পরিচালক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ছবিটা সব সময় একজন পরিচালকের মাধ্যম। পুরোটাই পরিচালকের তৈরি করা। অর্ধেন্দু সেনের ছবিগুলো দেখে মনে হয়, আমরা আজও ওই উচ্চতায় পৌঁছতে পারিনি। ওঁর ছবি আমাদের কাছে নস্টালজিয়া। অর্ধেন্দু সেন এবং ওই সময়ের অন্যান্য পরিচালকদের জন্যই আমরা উত্তমকুমারকে পেয়েছি। ‘হ্রদ’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক। ছবিটি অনেক আগে দেখেছি। স্কুল জীবনে। এককথায় অসাধারণ। ছবি বিশ্বাসকে বারবার রিপিট করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমরা অন্যরকম ভাবে পেয়েছি ওঁর ছবিতে। অর্ধেন্দু সেন এবং ওই সময়ের পরিচালকদের নিয়ে আরো বেশি চর্চা হওয়া উচিত।