সমুদ্রের নিচে খোঁজ-খবর চালালে যে অনেক সময়েই প্রাচীন শহর বা নগর-সভ্যতার সন্ধান মিলে যায়, এ আমাদের জানা আছে। লস আটলান্টিস-এর কথা আমরা ভুলিনি এখনও। সমুদ্র ছাড়াও ভূ-ভাগেও বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে খননকার্য চালিয়ে হরপ্পার মতো পুরাকালের কোনও সভ্যতাও কখনও-কখনও আবিষ্কার করে ফেলেন নৃতত্ত্ববিদেরা, সুতরাং এ-ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা প্রাচীন আস্ত শহরের হদিশ পাওয়া, তাও সেই জঙ্গলে না ঢুকেই— এরকম কিছু শোনা যায় কি বড় একটা?
আরও পড়ুন-রাজ্যসভা : আজ মনোনয়ন তৃণমূল প্রার্থীদের
হ্যাঁ এইরকমই ঘটেছে সম্প্রতি। তবে আমাদের দেশে নয়, এ-ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত সেই জঙ্গলে, যাকে আমরা অ্যামাজন নামেই ছোটবেলা থেকে চিনি। ব্রাজিল, পেরু আর অন্য কয়েকটা দেশ মিলিয়ে যে ঘন জঙ্গলের বিস্তার, সেই জঙ্গলে নাকি অ্যানাকোন্ডার মতো ভয়ানক সব প্রাণী থাকে, থাকে আরও বহু আশ্চর্য সব চেনা-অচেনা জানোয়ার বা অদ্ভুত গাছপালা; এরকমই শুনে এসেছি আমরা। তবে এবারে যে জিনিসের সন্ধান মিলল ওই জঙ্গলের সীমানার মধ্যেই, তা সাম্প্রতিককালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার।
এই জঙ্গলেই যে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এক উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, সেটাই এবার আবিষ্কার করেছেন এক দল নৃতত্ত্ববিদ। সুন্দর গোছানো ওই শহরের নানান চিহ্ন তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন ওই জঙ্গলের মধ্যেই, আন্দিজ পাহাড়ের কোলের এক উপত্যকায়। যে সভ্যতা টিকেছিল প্রায় দু-হাজার বছর।
আরও পড়ুন-ফের অক্সফোর্ডের আমন্ত্রণ, ‘শিক্ষিকা মমতা’র স্কুল সাজিয়ে ভবানীপুরে উদ্বোধন মুখ্যমন্ত্রীর
অনুসন্ধানের ফলে জানা গেল কী কী—
ফ্রান্স, জার্মানি, ইকোয়েডর বা পেরু থেকে একত্রিত হওয়া এক গবেষকদলের কয়েক বছরের পরিশ্রমের ফসল এই আবিষ্কার। ওঁদের মধ্যে প্রধান হিসেবে আছেন স্টেফেন রোস্টেইন (Stephen Rostain), যিনি এই আবিষ্কারটাকে বলছেন সত্যিই ‘ইনক্রেডিবল!’
ওঁরা কাজটা কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছিলেন অনেক বছর ধরেই। ওই গবেষক দল ‘সায়েন্স’ পত্রিকার সাম্প্রতিক একটা সংখ্যায় প্রকাশ করেছেন এই খবরটা। যেখান থেকে জানা যাচ্ছে যে আধুনিক নগর সভ্যতার সঙ্গে ওই এলাকার মিল বহু দিক থেকেই। ওঁদের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে যে প্রায় ছশো বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে প্রায় ছ-হাজার ছোট-ছোট বাড়ি, প্রত্যেকটার মধ্যে সমান ফাঁক রাখা। নির্দিষ্ট সজ্জায় সজ্জিত এই বাড়িগুলো আবার গড়ে তোলা হয়েছে এক-একটা উঁচু আয়তাকার সমতল মঞ্চের ওপর (কয়েকটা মঞ্চ গোলাকার), যেন পাশের রাস্তা থেকে কিছুটা উঁচু করতেই এই পদক্ষেপ। বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছিল একই ধরনের রাস্তা, সে-রাস্তা মনে করায় আধুনিক পরিকল্পিত শহরকে। গোটা এলাকায় ছড়ানো কয়েকটা জায়গায় আছে ওই প্ল্যাটফর্মগুলোর চেয়ে আরও উঁচু এবং আরও বড় কিছু প্ল্যাটফর্ম, গবেষকদের ধারণা ওগুলো বানানো হয়েছিল কোনও সভা-সমিতি বা অনুষ্ঠানের জন্য। যেন ওগুলো মুক্তমঞ্চ!
আরও পড়ুন-পড়ুয়ারাই গড়ল বাগদেবীকে, দিল আলপনা
এ-ছাড়া কিছু-কিছু জায়গায় রয়েছে নালার মতো কয়েকটা লম্বা গঠন, যেগুলো ঘিরে আছে এক-একটা এলাকাকে। কোথাও আবার ওই নালা রাস্তার ওপর দিয়েও বিস্তৃত, অনুমান বাইরের শত্রুর হাত থেকে বা এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর বিবাদের সময় ওই নালা বা খালের মতো অংশগুলো শত্রুদের আটকাতে কাজে লাগত। আমাদের কলকাতায় মারাঠা হানাদারদের থেকে বাঁচতে এককালে যেমন একটা বড় এলাকাকে ঘিরে খাল কাটা হয়েছিল, অনেকটা সেইরকমই।
আবার রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা, যেখানে সম্ভবত চাষবাস হত। সেই এলাকার সঙ্গে শহরের অন্য এলাকাগুলোর যোগ স্থাপিত হয়ে আছে কিছু সরু রাস্তার মাধ্যমে। ওই পথ দিয়ে সকলে চাষ করতে যেত বা ফসল আনার কাজে ব্যবহৃত হত। অনেকটা এই কারণেই এই শহরকে ওঁরা বলছেন ‘গার্ডেন সিটি’ বা বাগিচা-শহর। অ্যামাজনের অরণ্যে প্রাচীন কালে মানুষ যে শুধু শিকার করে বা জঙ্গল থেকে খাবার জোগাড় করে টিকে থাকত তা নয়, এই আবিষ্কার ওর পাশাপাশি এটাও দেখাচ্ছে যে এই অরণ্যে এককালে কৃষি-নির্ভর সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল। গুয়াতেমালা, ব্রাজিল বা মেক্সিকোর জঙ্গলের মধ্যে এইরকম কিছু সভ্যতার সন্ধান মিলেছিল আগেই, এই আবিষ্কার এটাও দেখাল যে অ্যামাজনেও একইভাবে নগর-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এক কালে।
আরও পড়ুন-এবার টিকটকে এলেন বাইডেন
তা কীভাবে সন্ধান মিলল ওই শহরের?
এখানেই আসল মজা। এই কাজের জন্য ওঁরা যে প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছিলেন, সেটার নাম ‘লিডার’। না, এই লিডার মানে কোনও নেতা নয়, এটা আসলে ‘লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং’-এর প্রথম অক্ষরগুলো পরপর বসিয়ে তৈরি করা শব্দ। একই ধরনের আর একটা শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত, তা হল ‘লেজার’, যার পুরো কথা ‘লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অভ রেডিয়েশন’। প্রচণ্ড শক্তিশালী লেজার আলো দিয়ে ঘটিয়ে ফেলা যায় অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা, আর এই লিডার ব্যবস্থার সাহায্যেও শক্তিশালী আলো পাঠিয়ে কোনও জায়গার দূরত্ব বা অন্যান্য তথ্য জেনে নেওয়া যায়। অন্ধকারে কোনও জিনিসের ওপর টর্চের আলো ফেলে যেমন সেই জিনিসটাকে দেখে নেওয়া সম্ভব, তেমনই এই লিডার ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে যেসব এলাকায় সরাসরি যাওয়া অসম্ভব বা যেখানে আলো ফেলে দেখবার উপায় নেই, সেখানে এই লিডার ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে এই লিডার ব্যবস্থার একটা অত্যাবশ্যক অংশ কিন্তু এই লেজার-ই।
এই লিডার ব্যবস্থার সাহায্যে অনেক ওপর থেকে লেজার আলো ওই জঙ্গলের ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে নিচের দিকে ফেলে সেখানে কী ধরনের জিনিস রয়েছে তার ছবি তুলে ফেলা যায়। সেই ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছে এত সব ব্যাপার। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এইভাবে প্রাচীন সভ্যতার হদিশ মিলে যাওয়া, নিঃসন্দেহে কোনও সিনেমার প্লট হিসেবে মন্দ নয়, কী বলেন!