সুখেন্দুশেখর রায়: ১৯৬৭ সাল। একটানা তিরিশ বছর কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার পরে এই প্রথম ধাক্কা খেল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে। অজয় মুখোপাধ্যায়, ড. প্রফুল্ল ঘোষ, হুমায়ুন কবীর, সুশীল ধাড়া-র মতো কংগ্রেস নেতারা কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ লাহিড়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তুললেন যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু অচিরেই সারা রাজ্যে নৈরাজ্য নেমে আসে। স্কুল-কলেজে বিক্ষােভ-বিশৃঙ্খলা, খেতে-খামারে জমি দখল, ফসল লুঠ, কল-কারখানায় ঘেরাও, নকশালবাড়িতে কৃষক আন্দােলন, শুরু হল ব্যাপক খুনোখুনি। ১৯৬৮-র ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলায় প্রথম রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল। এই সময় প্রদেশ ছাত্র পরিষদের সভাপতির পদে শ্যামল ভট্টাচার্যর জায়গায় সভাপতি নির্বাচিত হন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সহ-সভাপতি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সাধারণ সম্পাদক বাদল ভট্টাচার্য, পরর্তীতে সৌগত রায়। তখন থেকেই জাতীয়তাবাদী ছাত্র মহলে প্রিয়-সুব্রত জুটি সবার নয়নের মণি। আমি তখন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একের পর এক কলেজ নির্বাচনে আমরা জিতেছি। তখন মহাজাতি সদনের দোতলায় ছাত্র পরিষদের কার্যালয়। প্রিয়দা খড়দহে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সিপিআই(এম)-এর গুন্ডাদের হাতে মার খেয়ে পালিয়ে আসেন। আর যাননি সেখানে। একইভাবে কুমুদ ভট্টাচার্যকে বেহালা, সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ছাড়তে হয় বাটানগরের সারেঙাবাদ। এর পর যুক্তফ্রন্টের উত্থান, আবারও রাষ্ট্রপতির শাসন, নকশাল-সন্ত্রাস—বাংলায় চলছে রক্তের হোলিখেলা। এই রাজ্যে এমন কোনও শ্মশান ছিল না যেখানে জাতীয়তাবাদী কর্মীদের শেষকৃত্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, প্রিয়রঞ্জন, সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে যেতে হয়নি। তবে সবার মধ্যে অসম সাহসী ছিলেন সুব্রতদা। ১৯৬৯ সালে দলের সর্বভারতীয় পর্যায়ে ভাঙনের সময় ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে ছিলেন সিদ্ধার্থ, প্রিয়, সুব্রত প্রমুখ অনেকেই। ইন্দিরাজিও এই তিন নেতাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হওয়ায় এই রাজ্যের প্রেক্ষাপটও পাল্টে যায়। নকশাল দমনের পরে কংগ্রেস রাজনীতিতেও গোষ্ঠী কোন্দল চরমে ওঠে। ১৯৭৮ সালের ১-২ জানুয়ারি পরাজিত ইন্দিরা গান্ধী দিল্লির বিঠলভাই প্যাটেল ভবনের লনে নতুন দল তৈরি করলেন — ‘ইন্দিরা কংগ্রেস’। প্রিয়রঞ্জনের ভাষায় ইন্দিরাজি তখন ‘কংগ্রেসের ক্যানসার’। অধিবেশনের প্রথম দিন মনস্থির করতে না পারায় সুব্রতদা দিল্লি আসেননি। দ্বিতীয় দিনে যোগ দিলেন। এই প্রথম ‘প্রিয়-সুব্রত’ জুটি আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু ইন্দিরাজির কাছে সুব্রতদার গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। কারণ, ওই বছর ৩ জানুয়ারি ব্যাঙ্গালোরে (বেঙ্গালুরু) রেড্ডি কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন বলেছিলেন ‘‘ইন্দিরা কংগ্রেসে ‘ক্যানসার’ সৃষ্টি করেছিলেন। আমরা এখন ক্যানসারমুক্ত।’’ ৬ জানুয়ারি সুব্রতদা জবাব দিলেন— ‘‘প্রিয়দা একটা ভণ্ড। ও এক সময় নিজেকে ইন্দিরাজির ছেলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করত। আর এখন বলছে ক্যানসার। ওর ভণ্ডামির মুখোশ আমরা খুলে দেব।’’ ইন্দিরাজি সুব্রতদাকে কত ভালবাসতেন তার দু’-একটা ঘটনা বলি। ইন্দিরাজি তখন ক্ষমতায় নেই। অসম যাওয়ার পথে অল্প সময়ের জন্য কলকাতার এয়ারপোর্ট হােটেলে উঠেছেন। রাজ্য নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন রাতে। ভোর থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিমানবন্দরে কোনওভাবে পৌঁছেছি আমি, বরকতদা (তখন প্রদেশ সভাপতি) আর সুব্রতদা। ইন্দিরাজি চলে গেলেন। এক কোমর জল ভেঙে ভিআইপি রোড ধরে গাড়িতে আমরা ফিরলাম কলকাতায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে ফিরতে। সবে সুব্রতদা বাড়ি ফিরেছেন। ফোন বেজে উঠল। অপর প্রান্তে ইন্দিরাজি স্বয়ং। ‘‘সুব্রত আসামের প্লেন শেষ পর্যন্ত ছাড়েনি। ফিরে এসেছি এয়ারপোর্ট হোটেলে। তুমি চলে এসো।’’ সুব্রতদা আবার ছুটলেন, বিকেলে এক কাপড়ে ইন্দিরাজির সঙ্গে গেলেন অসমে। সেখানে পৌঁছে কোনও এক জনসভায় গিয়েছিলেন চপারে পাশাপাশি বসে। একই সিটবেল্টে বাঁধা দু’জনে। সুব্রতদা পরে আমাকে বলেছিলেন, প্রায় ৪০ মিনিট দমবন্ধ অবস্থায় কাটিয়েছিলাম। পরে ইন্দিরাজি এমন সব মজার কথা বললেন যে আমার সব আড়ষ্টতা কেটে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন-ইন্দিরাজির সঙ্গে সেদিন সেই কপ্টারে
সুব্রতদা তাঁর রাজনীতির জীবনে বহুবার আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল, বিধানসভা কক্ষের ভিতরে বর্বর পুলিশি আক্রমণ। ১৯৮৩ সাল। দ্বিতীয়বারের জন্য বামফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সেই সময় বিধানসভার অধিবেশনে কোনও একটি বিষয়ে সরকারপক্ষ আলোচনায় রাজি না হওয়ায় কংগ্রেস বিধায়করা অধিবেশন কক্ষেই ধরনায় বসে পড়েন। সন্ধের পর স্পিকারের নির্দেশে দলে দলে পুলিশ অধিবেশন কক্ষে ঢুকে পড়ে। নির্বিচারে লাঠি চালায়। গুরুতর আহত হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. শিশির বসু, ডাঃ মানস ভুঁইয়া-সহ ডজন খানেক বিধায়ক। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে খবর পৌঁছয়, সুব্রতদা-র বুকে ও কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইন্দিরাজি। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংকে ডেকে বললেন —‘‘Tell Jyoti. I will dismiss his Government if anything happens to Subrata.’’ এমনই স্নেহ করতেন ইন্দিরাজি সুব্রতদাকে। নয়ের দশকে সুব্রতদা প্রায়ই বলতেন, দিল্লির কংগ্রেস এই রাজ্যের কংগ্রেসকে সিপিআই(এম)-এর কাছে লিজ দিয়ে দিয়েছি। আমরা পারব না। তবে দেখিস, মমতাই একদিন ওদের ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবে। সুব্রতদার ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছে। তারপরেও তাঁর রাজনীতির জীবনে অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। বাংলার রাজনীতিতে এমন বর্ণময়, অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও কুশলী প্রশাসক আমার নজরে খুব একটা পড়েনি। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।