পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রথম যে জাতি আপন করে নিয়েছিল তারা অবশ্যই বাঙালি। শুধু পুরুষই নয়, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি-চন্দ্রমুখী বসুর মতো নারীরাও পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে নিজেদের উদ্ভাসিত করেছিলেন। কিন্তু, মহিলা! সে তো হাতেগোনা, কয়েকজন। পুরুষ-প্রধান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম নারী হিসাবে চিকিৎসক থেকে গ্র্যাজুয়েট আমরা পেলেও, পুরুষ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে, হেলমেট-গামবুট পরে লোহালক্কড় নিয়ে দিনরাত এক করে মহিলাদের কাজ! আসলে বেশি পরিশ্রমের কাজ মানেই তো পুরুষ। মহিলারা করবেন ছোট্টখাট্টো কাজ। বেশি পরিশ্রমের নয়, এমন কাজই মহিলাদের পক্ষে যথেষ্ট। ভুল ভাবনার এই জগদ্দল পাথর সরিয়ে কিছু করে দেখিয়েছিলেন ৪ বাঙালি নারী। ভারতের প্রথম মহিলা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সোনালি ব্যানার্জি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইলা মজুমদার, ইলেক্ট্রো-কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায় এবং টানেল ইঞ্জিনিয়ার অ্যানি সিনহা রায় আজ দেশের সমস্ত মহিলার গর্ব।
সোনালি ব্যানার্জি
কাকা কাজ করতেন মার্চেন্ট নেভিতে। ফলে ছোট থেকে কাকার মুখে সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা শুনতে শুনতেই ছোট্ট সোনালি ভেবে নিয়েছিল সে-ও একদিন সমুদ্র জয় করবে। ১৯৯৫ সালে যখন প্রথম মহিলা হিসাবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকা পাশ করেন সোনালি, তখন রীতিমতো হইহই পড়ে গেল তারাতলার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কারণ হস্টেল তো দূরের কথা, একজন মহিলাকর্মীও নেই কলেজে৷ কলেজে অধ্যাপকদের জন্য নির্দিষ্ট একটি কোয়ার্টারে থাকতে হলেও প্রথম দিকে সোনালিকে সহ্য করতে হয়েছিল পুরুষ সহপাঠীদের তাচ্ছিল্য। সেই পুরুষপ্রধান কলেজ থেকে একাকী নারী হিসেবে যুদ্ধ শুরু সোনালির। পাশ তো করলেন, চাকরি? কোনও কোম্পানি যে তাঁকে ট্রেনিংয়ে নিতেই রাজি নয়৷ অবশেষে মোবিল শিপিং কোং সংস্থায় সুযোগ মিলল শর্তসাপেক্ষে ট্রেনিংয়ের। শর্ত ছিল, কোনওরকম ভুল হলে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷ করে দেখালেন তিনি। মহিলা হিসেবে প্রথম সাফল্যের সঙ্গে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, ফিজি হয়ে ভেসে গেলেন সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। ফিরে এসে, প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে ২০০১ সালেই এক মার্চেন্ট নেভির দায়িত্ব পেলেন তিনি।
ইলা মজুমদার
বাংলার প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার তথা ভারতের প্রথম মহিলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। শিবপুর বিই কলেজের প্রথম ছাত্রী। শিক্ষানবিশির জন্য গ্লাসগো যাওয়া ভারতের প্রথম মহিলা। ভারতের প্রথম মহিলা যিনি দেরাদুনের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে ভারী যন্ত্রাংশ তৈরির বিভাগে কাজ করেছেন। কলকাতার প্রথম (ভারতের দ্বিতীয়) মহিলা পলিটেকনিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি, ইলা মজুমদার।
বাবা যতীন্দ্রকুমার মজুমদার ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস), এমএসসি-তে প্রথম শ্রেণির প্রথম। ছোটবেলা থেকেই ইলা ছিলেন অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা। ১২ বছর বয়সে সাইকেল আর ১৬ বছর বয়সে বাবার জিপ চালানো যখন শিখছেন, তখনই অনেকে জিভ কেটেছিলেন। পাত্তা দেননি তিনি। পরবর্তীকালে, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পেলেও তিনি ডাক্তারি পড়তে গেলেন না। গেলেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে— যেটা এতদিন শুধুমাত্র পুরুষরাই পড়তে পারত। তৎকালীন শিবপুরের কয়েকশো ভারতীয় এবং ইউরোপিয়ান ছাত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র ছাত্রী। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারত সরকার মহিলাদের জন্য শিক্ষার সব ক্ষেত্র খুলে দেয়। সেই বছরই অনেক বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও, ইলা মজুমদার ভর্তি হন শিবপুরের মেকানিক্যাল বিভাগে। প্রাথমিকভাবে তিনি প্রিন্সিপালের বাংলো (যা আমরা এখন হোয়াইট হাউস বলি, নদীর পাশের ডানদিকে কোনার ঘর)-র একতলার আবাসনে জায়গা পেলেও পরে তাঁকে লাইব্রেরির বাম কোণে একটি ঘরে চলে যেতে হয়েছিল। পুরো লাইব্রেরিতে তিনি একা থাকতেন মেট্রন উষা চৌধুরিকে নিয়ে। তাঁদের খাবার ডাউনিং হস্টেল থেকে আসত। তিনি পরে বলেছিলেন, ‘‘আমরা ৬ বোন ছিলাম এবং আমার বাবা ধনী ছিলেন না বলে বেশিরভাগ দিন আমাকে প্রাতরাশ ও টিফিন এড়িয়ে চলতে হয়েছিল।’’ বিকেলে তাঁদের আঁকার ক্লাস ছিল। সেই দিনগুলিতে তাঁকে ড্রয়িং বোর্ড এবং টি-স্কোয়্যার বহন করতে হত এবং তিনি দেখতেন কৌতূহলী ছেলের দল বাইরে থেকে তাঁর ক্লাসরুমে উঁকি দিচ্ছে শুধু এই কারণে যে একটি মেয়ে কীভাবে আঁকাজোকা করে চলেছে!
১৯৫১-তে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য গেলেন গ্লাসগো। কারণ, শিবপুরের প্রিন্সিপাল ভেবেছিলেন ভারত তখনও মহিলা ইঞ্জিনিয়ারের কাজের জন্য উপযুক্ত হয়নি। যদিও ট্রেনিং শেষে ভারতে ফিরে এসে, দেরাদুনের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কাজে যোগ দেন তিনি। স্টাফ কোয়ার্টারে একাই থাকতেন। পরে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। প্রথমে দিল্লি পলিটেকনিক এবং পরে কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ জুট টেকনোলজিতে, লেকচারার ছিলেন। কলকাতার মহিলা পলিটেকনিক গড়ে ওঠে তাঁদের কয়েকজনের উদ্যোগেই। এবং ইলা ছিলেন প্রথম প্রিন্সিপাল। এরপর ১৯৮৫ সালে ইউএনও-র তরফে থেকে তাঁকে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে একটি মহিলা পলিটেকনিক কলেজ খোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায়
জন্মসূত্রে কর্নাটকের মানুষ হলেও বিবাহসূত্রে পুরোদস্তুর বাঙালি তিনি। কারণ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের গবেষক শিশিরকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি ও তাঁর স্বামী মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর গবেষণা শুরু করেন। দু’জনে মিলে একটি গবেষণাগার গড়ে তোলেন মাইক্রোওয়েভ গবেষণার জন্য। তিনি রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায়। কন্যা ইন্দিরা চট্টোপাধ্যায় ইলেক্ট্রো ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসর হিসাবে নিযুক্ত রয়েছেন নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে (রেনো, ইউএসএ)। রাজেশ্বরী কর্নাটক-এর প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ার এবং বাংলার প্রথম মহিলা কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। ঠাকুরমার তৈরি স্পেশাল ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ‘সেন্টার কলেজ অফ ব্যাঙ্গালোর মহাবিদ্যালয়’ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক হন। ১৯৫৩-তে পিএইচডি শেষ করে কর্মজীবনে একশোর বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন এবং অনেকগুলি বই লিখেছেন। একই সময়ে তিনি ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অস সায়েন্সের প্রফেসর ও ইলেক্রোত কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপার্সন হিসাবে নিযুক্ত হন। প্রধানত ম্যাগনেটিক থিয়োরি, মাইক্রোওয়েভ টেকনোলজি, ইলেক্ট্রন টিউব সার্কিট বিষয়ে তিনি শিক্ষাদান করতেন।
অ্যানি সিনহা রায়
একজন মহিলা ভারী ভারী মেশিন তুলছেন, টানেলের মধ্যে মেশিন মেরামতির কাজ করছেন, বেশ খাটনির সঙ্গে সব কিছু করতে দেখে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কখনও কখনও। কিন্তু, এই সাহায্যকারীর হাত তো বেশি নেই। নিজের কাজটা তাই নিজে করতেই বেশি ভালবাসেন। টানেলের মধ্যে আরও বেশিসংখ্যক মহিলা কাজ করতে এগিয়ে আসুক, এটাই প্রার্থনা দেশের মহিলা টানেল ইঞ্জিনিয়ারের। যিনি স্বামীর সঙ্গে সুখের সংসারও করেন। তিনি অ্যানি সিনহা রায়। যিনি দেশের প্রথম ও একমাত্র মহিলা টানেল ইঞ্জিনিয়ার। কাজ করতে করতে কখন যে মুখে হাইড্রোলিক তেল লেগে যেত বুঝতে পারতেন না। কর্মীরা বলতেন, ‘‘জীবনের বাকি সময়টা ঠিকভাবে কাটাতে মুখটাকে কেন খারাপ করছ?’’ শুনতেন না। অ্যানি বেঙ্গালুরুর সামপেইগ রোড থেকে ম্যাজেস্টিক পর্যন্ত মেট্রো রেলের ভূগর্ভস্থ কাজে ব্যস্ত। সেটাই নিজের ঘর-বাড়ি।
সবার আগে যে সমস্যার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তা সত্যিই ভয়ানক। না আছে টয়লেট, না আছে বসার জায়গা। কাজের প্রথম দিনে তাঁকে দেখে সকলেই ভেবেছিলেন একজন পরিদর্শক হিসেবে দিল্লি মেট্রোর কাজ দেখতে এসেছেন। কারণ, মেট্রোর কাজে পুরুষ কর্মীর সংখ্যাই বেশি, তাঁদের মধ্যে কর্মী ও ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, অ্যানি মেট্রোর টানেলের কাজে বেশিদিন স্থায়ী থাকতে পারবেন না। কাজের প্রথম দিনে অ্যানির অভিজ্ঞতা কিন্তু মধুর নয়। বড় বড় মেশিনের পাশে তিনি প্রায় দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলেন, শুধুমাত্র কাজের নির্দেশ পাওয়ার জন্য। এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, টানেলের মধ্যে একটি নাটবল্টু খুলে আনতে পারবেন কি না!
কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাটাও চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নাগপুর ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। বাবাকে হারিয়ে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়েছিল অ্যানির পরিবার। একবেলা ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হত। দিল্লি মেট্রোর কনট্রাক্টর সেনবো থেকে প্রথম অফারটা আসে তাঁর কাছে। ২০০৭ সালে অক্টোবর মাসে কাজে যোগ দেন মধ্য কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটি। এরপর ২০০৯ সালে যোগ দেন চেন্নাই মেট্রোতে।