লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর কম কটাক্ষ ভেসে আসেনি বিজেপির তরফ থেকে। খোদ মোদিজি বলেছিলেন, এ তো ‘রেউড়ি’, অর্থাৎ খয়রাতি। খয়রাতির ভাষা ‘রাজা-বাদশাদের ভাষা’। রাজা-বাদশারা মাঝে মাঝে গরিবগুর্বোকে দান খয়রাতি করতেন। এখন দেখা যাচ্ছে, বিজেপির মতো শাসককুল খয়রাতি দিয়ে ‘পাবলিক ইমেজ’ তৈরি করেন, আর তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের সাময়িক কষ্ট লাঘবের জন্যে কিংবা গরিবের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সেই কাজ করলে, সেই ‘জনমোহিনী নীতি’র বিরোধিতা করেন। সেই পদক্ষেপকে ‘রেউড়ি’ বলে মশকরা করেন। উত্তর ভারতে মন্দির, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাতাসার মতোই বিলি করা হয় একধরনের চ্যাপ্টা তিলের নাড়ু। সেটাকেই বলে ‘রেউড়ি’।
আরও পড়ুন-বাগ্দেবীর মণ্ডপসজ্জার থিম সাবেক ঠাকুর-দালান
তৃণমূল কংগ্রেস প্রবর্তিত রেউড়ির ফলশ্রুতি একটু দেখে নেওয়া যাক।
রাজ্যে চালু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প। যে মহিলার নিজের রোজগার নেই, অথবা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর দিনান্তে সামান্য কিছু জোটে যাঁর, তাঁর কাছে ওই ক’টা টাকার গুরুত্ব যে অসীম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিরিশ দিন অন্যের বাসন মেজে তবেই একজন হাজার টাকা পেতে পারেন, এটাই যখন নিয়ম, সেখানে কিছু না করেই ব্যাঙ্কে এক হাজার টাকা? এই যুক্তিতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকার কথা শুনলেই বিজেপির গায়ে জ্বালা ধরে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার শুধুমাত্র ১০০০ টাকা নয়। গরিব মহিলাদের কাছে এ এক স্বপ্নমালা। তাঁদের জীবনে না ছিল নতুন কিছু ভাবার সুযোগ, না কোনও নতুন স্বপ্ন— প্রায় গুরুত্বহীন জীবন। যা বদলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকার আসলে ব্যাঙ্কে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে টাকা নয়, ট্রান্সফার করছে একগুচ্ছ স্বপ্ন। নারী ক্ষমতায়নের এর থেকে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে! আপনার পছন্দ হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে, এটাই বাস্তব— পৃথিবীর ১১৯টি দেশে এই ধরনের শর্তহীন টাকা হস্তান্তরের কোনও না কোনও প্রকল্প চালু আছে। এই প্রতিবেদন খোদ বিশ্বব্যাঙ্কের। তবুও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথী, কন্যাশ্রী, কৃষকবন্ধুর মতো জনমুখী প্রকল্পগুলি নিয়ে ‘খয়রাতি’র অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ তোলেন গেরুয়া শিবিরের নেতারাই।
আরও পড়ুন-ফের ভারত বনধ কৃষকদের, কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় মিলল না সমাধান সূত্র
পাল্টা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জনগণের টাকায় মোদির কর্পোরেট সেবা কি রেউড়ি-সংস্কৃতি নয়? একের পর এক বাজেটে মোদি সরকার কর্পোরেট কর ছাড় দেওয়ার পথে হেঁটেছে। তার বদলে, কর্পোরেটের থেকে এই করের টাকা নিয়ে তা খরচ করা যেত বিভিন্ন সামাজিক খাতে। অথবা, একই অর্থমূল্যের কর ছাড় দেওয়া যেত জিএসটিতে। আসলে কোন পথটা বাছা হবে, আর কোনটা হবে না, সেই প্রশ্নের উত্তর যতখানি অর্থনীতির, তার চেয়ে ঢের বেশি রাজনীতির। পরোক্ষ করের চরিত্রদোষ হল, তা ধনী-দরিদ্রে বিভেদ করে না— সবাইকে সমান হারে কর দিতে হয়। দেশের সরকার গরিব মানুষের কথা ভাবলে পরোক্ষ করের হার কমায়। নির্মলা সীতারামনরা সে পথে হাঁটেননি। তার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার বেছে নিয়েছে ট্রিক্ল ডাউন অর্থনীতির পথ— অর্থাৎ, ধনীতমদের আরও বেশি ধনী হয়ে উঠতে দেওয়া এবং অপেক্ষা করা, বাজারের ধর্ম মেনে তাঁদের সেই সমৃদ্ধি কবে আম আদমির ঘরেও চুঁইয়ে নামবে। আসলে যে সেই সমৃদ্ধি কখনও গরিবের ঘরে পৌঁছয় না, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার যখন সর্বোচ্চ স্তরে ছিল, তখনও অসাম্য বেড়েছিল চড়চড়িয়ে। তবুও নির্মলা সীতারামনরা নির্দ্বিধায় কর্পোরেট করে বিপুল ছাড় দিয়ে গিয়েছেন। শুধু তাই-ই নয়, মোদি জমানায়, অর্থাৎ ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি, বিদেশি-সহ সব ব্যাঙ্কের বকেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই অনাদায়ী ঋণের থেকে ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছেও দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ, এই বিশাল পরিমাণ ঋণ মকুব করেছে মোদি সরকার। জানা গিয়েছে, এই বকেয়া ঋণের বড় অংশ আসলে কর্পোরেট ঋণ। আইনিভাবে এই মকুব ঋণের ৮০ শতাংশ ঢুকেছে কর্পোরেটদের কোষাগারে। ফলে গত আট বছরে আইনি ভাবে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে উধাও হয়েছে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এটা কি মোদি সরকারের খয়রাতি নয়?
আরও পড়ুন-পাঞ্জাব-হরিয়ানার সীমানায় মৃত্যু আন্দোলনরত কৃষকের
প্রশ্ন হল, আজ দেশের সাধারণ নাগরিক কেন রেউড়ির নৈবেদ্যতেই সন্তুষ্ট? এর জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করাই যায়, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যেসব অর্থনৈতিক বা কল্যাণমুখী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার ক’আনা বাস্তবায়িত হয়েছে? এমনকী, সবার অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে অমিত শাহ ‘জুমলা’ অর্থাৎ ‘কথার কথা’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়ার পরও কি কেউ প্রশ্ন করেছেন, ভোটে জেতার জন্য জেনে-বুঝে এমন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল কেন? বাংলার সাধারণ মানুষ বিজেপি রাজনীতির চরিত্রকে বিলক্ষণ বোঝে— বড় উন্নয়নের ‘জুমলা’য় তারা বহু বার বোকা হয়েছে। তাই হাতেগরম প্রাপ্তি ছেড়ে কেউ আর মরীচিকার পিছনে ছুটতে রাজি নয়। ফলে যে রেউড়ি সংস্কৃতি এক সময়ে মোদির দু’চক্ষের বিষ ছিল, এখন সেই গরল অমৃত জ্ঞানে পান করতে বাধ্য হচ্ছেন নিজেই।
একটা পুরোনো কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-পথে এখনই নামো সাথী, তৃণমূলের বৈঠকে অভিষেক বললেন
ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ইন্দিরা গান্ধীকে রিপোর্ট দিয়েছিল, আপনি লোকসভা ভোটে ৩৪০ আসন অন্তত পাচ্ছেনই। ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি দিল্লিতে দেখা করে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, আমাদের রাজ্যে ৮৫ সিটের মধ্যে ৭০টা তো পাচ্ছিই। ইন্দিরা গান্ধী নিশ্চিত ছিলেন। তবে ভোটপ্রচারের শেষদিকে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে একটি সভায় তিনি এবং দিলীপকুমার ছিলেন প্রধান দুই আকর্ষণ। অভিনেতা দিলীপকুমার বক্তৃতা দিলেন যখন, তখন খুব ভিড় এবং করতালি। কিন্তু দিলীপকুমারের ভাষণ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ভিড় কেটে যাচ্ছে। জনসভা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর কথা শোনার আগ্রহ নেই কারও। বিস্ময়কর লেগেছিল তাঁর কাছেও তবে কী…? এই প্রশ্ন মনে এলেও আমল দেননি তিনি।
১৯৭৭ সালের ২০ মার্চ পরিবার-ঘনিষ্ঠ আর কে ধাওয়ান ঝড়ের বেগে সফদরজং রোডে প্রবেশ করে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ম্যাডাম, ইউ আর ট্রেইলিং! অর্থাৎ আপনি পিছিয়ে আছেন গণনায়। অবিশ্বাস্য! রাত আটটা নাগাদ বন্ধু পুপুল জয়কার ড্রইংরুমে আসতেই ইন্দিরার গলা প্রথম ভেঙে গেল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, পুপুল, আই হ্যাভ লস্ট! ২২ মার্চ সমস্ত ফলাফল প্রকাশিত। ৭০ তো দূরের কথা। উত্তরপ্রদেশে একটিও আসন পায়নি কংগ্রেস। ৩৪০ স্বপ্ন! মোট আসন ১৫৪!
আরও পড়ুন-১৫ দিনের কর্মসূচি
কয়েকদিন আগে পর্যন্ত যিনি ছিলেন সর্বশক্তিমান, যিনি নিজেকে ভাবছিলেন ভারতের গণতন্ত্র, সংবিধান এবং স্বাধীনতারও ঊর্ধ্বে, তাঁকে নিমেষের মধ্যে ভারতীয় আম জনতা কোথায় এনে দাঁড় করাল?
আব কী বার চারশো পার! জওহরলাল নেহরু খারাপ। ইন্দিরা গান্ধী খারাপ। এবার বিরোধীশূন্য হবে লোকসভা। মনমোহন সিং-এর অর্থনীতি ব্যর্থ। ভারতে যা কিছু হয়েছে সব ২০১৪ সালের পরে হয়েছে। এসব যিনি এখন বলছেন ও প্রচার করছেন, তাঁর হাল যে কী হবে, সেটা ভাবতে বসেই ওইসব দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।