আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা। এ বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ যে কতদিনের পুরানো সে বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা নেই। তবে পণ্ডিতরা মনে করেন যে, যিশু খ্রিস্ট জন্মাবার প্রায় দু’হাজার বছর আগে এ প্রদেশে লোকের বসবাস ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য-সম্রাটদের রাজত্বের সময়েই আর্যদের বসবাস শুরু হয়। আর খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই এখানে আর্যরা ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গদেশ, বঙ্গজাতি— এই শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ নামক উপনিষদে। এই প্রদেশের দুটি নাম ছিল— একটি নাম ‘বঙ্গ’ যা পূর্ববঙ্গ বোঝানো হত, দ্বিতীয়টির নাম ‘রাঢ়’ এটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গের আরও একটি নাম ছিল ‘সুহ্ম’ আর উত্তরবঙ্গকে বলা হত পৌন্ড্র এবং মালদহকে বলা হত ‘গৌড়’। বাংলা ভাষা বাঙালির গর্ব ও আত্মপরিচয়। একথা ঠিক গত শতকের দুটি ঘটনা বাংলা ভাষাকে তার প্রাদেশিক সীমাবদ্ধতা থেকে ছড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিকতার দিকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি গীতাঞ্জলি-র প্রকাশ এবং সেই সূত্রে বাঙালির ঘরে নোবেল পুরস্কার। আর রাজা রামমোহন রায় মুসলিম শাসনামলের অভিজাত শ্রেণি তথা শিক্ষিত সমাজকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। কিন্তু পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নে সচেষ্ট হন। তাঁর যুগে বাংলা ভাষা কোনও প্রকার বিশ্বসাহিত্যের উপযোগী ছিল না। সূত্র মতে সেসময়ে ফার্সি ভাষা মিশ্রিত এক প্রকার মিশ্র জটিল ভাষার ব্যবহার দলিলে বা পত্র-পত্রাদিতে করা হত। ওইসময় রামমোহন একটি ছোট্ট ব্যাকরণ বই প্রণয়ন করেন। বাংলা সাহিত্যে শিশু-বোধক-রচনা প্রণয়নও অসম্ভব ছিল।
আরও পড়ুন-সহায়তা কেন্দ্রে বিজেপির সন্ত্রাস, প্রতিবাদে পথে তৃণমূল
‘বাঙ্গালদেশ’ শব্দটি পাওয়া যায় প্রথম রাজেন্দ্র চোলদেবের ১০১২-১০৪৪ (খ্রিস্টাব্দ) তিরুমলয় পর্বতের তামিল লিপিতে। দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠীর ‘আলম’ শব্দটি বঙ্গ শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাঙাল বা বাঙালি শব্দের উৎপত্তি। কোনও কোনও পণ্ডিতগণ মনে করেন যে বাঙালিরা ঠিক আর্য নয়। অস্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি। সেই সময় সংস্কৃত ভাষায় পড়াশোনা করতে হত। সব থেকে পুরানো গ্রন্থ ‘রামচরিত’ কাব্য। বাংলা সাহিত্যে অভিনন্দ নামে এক কবি রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে এ কাহিনি লিখেছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ সময়ে রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় বড় বড় কবির উল্লেখ আছে। যেমন উমাপতিধর, গোবর্ধন আচার্য, ধোয়ী ও জয়দেব প্রমুখ। জয়দেবকেই বলা হত আদি কবি। বর্তমান সময়ে কী রকম বেঁচে আছে বাংলা ভাষা? এই সময়ে। একুশ শতকে আচার্য লৌইপাদ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, কিংবা হাসনরাজার মতো সাধকগণ বাঙলা ভাষার প্রভূত প্রচার করেছিলেন। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে ঠাকুরবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ে আমাদের সকলের মধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনেক হয়েছে কিন্তু প্রকৃত যত্নবানের অভাব, প্রতিদিন বাঙালির হাতে বাংলা ভাষার কী চরম দুর্গতি দেখা যাচ্ছে। অথচ অবাক হতে হয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এক আত্মীয়ের চিঠি এসেছিল, ইংরেজি ভাষায় লেখা, তিনি সেই চিঠি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন। কবি লিখেছেন যে, ঠাকুরের পরিবারের সদস্যদের মাতৃভাষা-প্রীতি তিনি দেখেছেন এবং সেই ভাবেই বড় হয়েছেন। ১৮৯৭ সালে অবনীন্দ্রনাথ-সহ আরও অনেকে রাজনৈতিক সম্মেলনে ইংরেজি ভাষার বক্তব্যকে প্রত্যাখান করেছেন। ইংরেজি বললেই বাংলা বাংলা বলে বলে উত্ত্যক্ত করে কংগ্রেসের অধিবেশনে বাধ্য করেন বাংলাতে বলতে। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ১৯৩৭-এ প্রথা ভেঙে ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষার উচ্চারণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলার মাটি বাংলার জলের সঙ্গে বাংলার ভাষাও ছিল বড় আদরের।
আরও পড়ুন-পুলিশের পাঠশালায় তালিম নিয়ে চাকরি পেল ৩৫
অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা’ এবং বর্তমানে কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় ‘আমি বাংলায় গান গাই আমি বাঙলার গান গাই।’ ১৯৫২ সালের ভাষার আন্দোলন থেকে ’৭১। ভাষা শহিদদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। এই দিনটিকে ঘিরে প্রতি বছর বাঙালির আবেগ চোখে পড়ার মতো। অনুষ্ঠানের পোস্টার, প্রভাতফেরি, আরও কত কী। কিন্তু বাঙালির পরের প্রজন্মের কাছে ইংরেজি ভাষার প্রীতি কখনও কখনও দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা আক্ষেপ পোষণের দাবি করেন বুদ্ধিজীবী বা বাংলা সাহিত্যের প্রীতিজনেরা। কিন্তু কোনও জাতি কি নিজের ভাষাকে উপেক্ষা করে সমৃদ্ধ হতে পারে? প্রত্যেকেই নিজের মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। কোনও ভাষাকে অসম্মান করে নয়, কখনও প্রয়োজনে অথবা দেশের, সমাজের সমন্বয়ের জন্য অন্য ভাষার দ্বারস্থ হতে হয়। সে কখনও সংস্কৃতি লেনদেন বা সম্প্রীতি চেতনাবোধের সৃষ্টিও হতে পারে। সেই পথ দেখিয়েছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে মলিন করে নয় তা বুঝিয়ে ছিলেন ৩৫০০ বেশি সঙ্গীত রচনা করে। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। মুখের ভাষা বাংলাকেই প্রাদেশিক সীমাবদ্ধতা থেকে বিশ্বমুখী করতে হবে। বাংলা ভাষার প্রভূত উন্নতি সাধিত হোক। স্মরণে থাকুক একুশের ইতিহাস, সাহিত্য আত্মপরিচয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয় হোক।