কয়েক লক্ষ স্নায়ুকোষ দিয়ে আমাদের মানবমস্তিষ্ক গঠিত যা নিউরন নামে পরিচিত। এই নিউরনগুলো স্নায়ু দিয়ে শরীরের সব ক’টি অংশে অবিরাম বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়। কিন্তু নিউরন থেকে হঠাৎ অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠানো হলে স্নায়ুকোষের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে আচরণের পরিবর্তন দেখা দেয়।
আরও পড়ুন-ক্ষমা চান মোদি-নাড্ডা
অর্থাৎ এটা এমন এক মেডিক্যাল কন্ডিশন যেখানে শরীরের ঐচ্ছিক পেশিগুলো দ্রুত ও বারবার সংকুচিত ও শিথিল হয়। ফলে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার অন্য নাম সিজার। এই খিঁচুনি এক ধরনের মস্তিষ্কের রোগ বা নিউরোলজিক্যাল ডিজিজ। এটা ৩০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট স্থায়ী হয়। খুব গুরুতর হলে সেটা পাঁচ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই বা ততোধিকবার খিঁচুনি হয় তাহলে এটিকে মৃগীরোগ বলে ধরে নেওয়া হয়।
খিঁচুনির সঙ্গে সঙ্গে রোগী দাঁত দিয়ে জিভ কেটে ফেলতে পারেন, কোনওভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন, নিজের অজান্তে কখনও কখনও মল-মূত্রও ত্যাগ হয়ে যেতে পারে। মৃগীরোগীদের ক্ষেত্রে যে ঝাঁকুনি হয় তা খিঁচুনি নাও হতে পারে। কারণ সমস্ত খিঁচুনি মৃগীরোগের কারণে কিন্তু হয় না।
প্রাপ্তবয়স্কের খিঁচুনির কারণ
অধিকাংশ স্নায়বিক সমস্যার মতো খিঁচুনিরও কোনও নির্দিষ্ট কারণ জানা নেই। তবে এর পরিচিত একটি কারণ হল মৃগীরোগ। অন্যান্য বহু কারণ রয়েছে :
জিনের পরিবর্তন এবং জিনগত কারণে খিঁচুনি হতে পারে।
মস্তিষ্কের টিউমার, মাথায় আঘাত, স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যা, মস্তিষ্কের প্রদাহ বা ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্স রোগ।
আরও পড়ুন-মহিলার গোপন জবানবন্দি, পুলিশ হেফাজতে সেই যুবক
কোনও ধরনের সংক্রমণ। স্ট্রোক।
হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাসের (এইচআইভি) সংক্রমণ।
মদ্যপান ও মাদক সেবন।
ঘুমের অভাব, জ্বর।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যানালজেসিক, ডাই-ইউরেটিক প্রভৃতি ওষুধের প্রভাবে।
খিঁচুনির ধরন
ফোকাল সিজার এবং জেনারালাইজড সিজার— এই দু’ধরনের খিঁচুনি হয়। জেনারালাইজড সিজার সাধারণত শিশুদের বেশি হয়।
ফোকাল সিজার
ফোকাল সিজার উৎপন্ন হয় মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ থেকে। এর উপসর্গগুলো হল—
শরীরের যে কোনও অংশের আকস্মিক বিচলন।
সচেতনতার পরিবর্তনের ফলে চলন ও ক্রিয়াকলাপের বদল।
আক্রান্ত ব্যক্তির আলোর জ্যোতি দেখার অভিজ্ঞতা হতে পারে।
বাস্তবে উপস্থিত নয় এমন শব্দ, গন্ধ বা স্বাদের অনুভূতি।
কী করবেন
খিঁচুনি হওয়ার আগের মুহূর্ত অবধি রোগী বুঝতে পারে না বা বুঝতে পারলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সময় পান না। একেবারে হঠাৎ করেই এটা শুরু হয়ে যায়। আশপাশে যাঁরা থাকেন তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। বুঝে উঠতে পারেন না কী করণীয়। কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে যদি সেই সময় ঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া যায় রোগীর বিপদের আশঙ্কা থাকে।
খিঁচুনি শুরু হলে দেখুন রোগী কোথায় রয়েছে অর্থাৎ পথ-ঘাট, অফিস, রান্নাঘর, তাহলে যে অবস্থায় আছেন বসিয়ে দিন এবং ধীরে ধীরে শুইয়ে দিন।
যদি নিউরো পেশেন্ট হন তবে হয়তো বসা অবস্থাতেই সিজার হতে পারে সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে শুইয়ে দিন। খিঁচুনি হওয়ার পর মুখ থেকে প্রচুর গ্যাঁজলা ধরনের লালা বেরতে শুরু করে যা শ্বাসনালিতে গেলে মারাত্মক জটিলতা আসতে পারে। তাই পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিন যাতে ওটা শ্বাসনালিতে না যায়।
মাথার নিচে বালিশ দিন। না থাকলে কোনও কাপড় দিয়ে উঁচু করে দিন মাথাটা।
খানিকক্ষণ শুইয়ে রাখুন। রোগী স্বাভাবিক হলে ওআরএস দিতে পারেন। সাধারণত খিঁচুনির পর রোগী ভুলে যান তাঁর কী হয়েছিল তাই তাঁকে আর সেটা মনে করাবেন না। যদি দেখা যায় খিঁচুনি মাঝেমধ্যেই হচ্ছে তবে অবশ্যই এটা আটকাতে হবে এবং ওষুধ খেতে হবে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আরও পড়ুন-সন্দেশখালিতে বিরোধীদের নাটক, প্ররোচনা; পুলিশকে ‘খালিস্তানি’ বলল গদ্দার, প্রতিবাদে শিখ-ধরনা
শিশুর খিঁচুনি
নবজাতক, বিশেষত সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র কিছুটা অপরিপক্ব থাকায় খিঁচুনির লক্ষণ পুরোপুরি প্রকাশিত হয় না। নবজাতকের চার ধরনের খিঁচুনি দেখা যায় : শাটল সিজার বা সূক্ষ্ম খিঁচুনি। এটাই বেশি হয় শিশুদের। প্রায় ৫০ শতাংশ। সাধারণত মা-বাবার পক্ষে এটা নিরূপণ করা বেশ কঠিন।
এছাড়া ক্লোনিক সিজার, টনিক সিজার ও মায়োক্লোনিক সিজার এগুলো বড়দেরও হতে পারে।
কেন হয় শিশুর খিঁচুনি
জন্মের পরপরই নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। জন্মের ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা পর সে আগের তাপমাত্রায় ফিরে আসে। প্রসব রুমের তাপমাত্রা বেশি শীতল হলে কোল্ড ইনজুরি থেকে কাঁপুনি হতে পারে যা ভুলবশত খিঁচুনি বলে মনে হয়।
নবজাতক শিশুর বেশ কয়েকটি রোগ, যেমন অক্সিজেন-স্বল্পতায় ভোগা, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, মস্তিষ্কের ইনফেকশন, রক্তের সুগার কমে যাওয়া ইত্যাদির অন্যতম লক্ষণ খিঁচুনি। এছাড়া অপরিপক্ব নবজাতকের ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দ করা, অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত হলে বা রক্তের ক্যালসিয়াম কম হলে হাত-পা কিংবা পুরো শরীরে সাধারণ কাঁপুনি হতে পারে। এই দুইয়ের তফাত বুঝতে হবে।
খিঁচুনি ছাড়াও নবজাতকের শরীরে আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন ঝিমিয়ে পড়া, বুকের দুধ খেতে অনীহা, হঠাৎ ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া, জ্বর, শ্বাসের গতি বেশি হওয়া, বুক দ্রুত ওঠানামা করা, গলায় ঘড়ঘড় শব্দ করা ইত্যাদি। এর মধ্যে এক বা একাধিক লক্ষণ থাকলে বুঝতে হবে নবজাতক গুরুতর সমস্যায় ভুগছে।
আরও পড়ুন-শাহকে ‘খুনি’ বলায় গ্রেফতার রাহুল, আধঘণ্টায় জামিন কোর্টে
কী করবেন
নবজাতককে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে।
ব্রেস্ট ফিড করানো।
হাসপাতালে নেওয়ার সময় নবজাতককে উষ্ণ রাখতে হবে।
কয়েক স্তরের সুতির কাপড় পরিয়ে নবজাতককে উষ্ণ করে রাখতে হবে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা
ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যের অভাব রয়েছে কি না দেখতে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।
ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম।
ম্যাগনেটিক রেসোনান্স ইমেজিং (এমআরআই)
পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি (পিইটি) স্ক্যান।
কিছুক্ষেত্রে খিঁচুনি মাত্র একবারই ঘটতে পারে, এবং এর কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
যদি বারবার খিঁচুনি হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, যেমন বেশি তেলযুক্ত, কম-শর্করাযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।
মৃগীজনিত খিঁচুনি
এপিলেপ্টিক অ্যাটাক বা মৃগীর যে খিঁচুনি তা ওষুধ খেয়েই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কতদিন ওষুধ খেতে হবে তার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।
এপিলেপ্সি দু’ধরনের হয়— প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি। প্রাইমারি এপিলেপ্সির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা ৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে দেখা দেয়। সেকেন্ডারি এপিলেপ্সি পাঁচবছরের কম বয়সে এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সে দেখা যায়।
প্রাইমারিতে সাধারণত এক ধরনের ওষুধ দিয়েই খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডোজও কম লাগে। পাঁচ থেকে সাত বছরে সুস্থ হয় রোগী। তবে নিজে থেকে ওষুধ বন্ধ করবেন না।
সেকেন্ডারি এপিলেপ্সিতে কিন্তু আজীবন ওষুধ খেতে হবে। কোন কারণে খিঁচুনি হচ্ছে তার চিকিৎসা করতে হবে।