মারি কুরি নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত মহিলা। পেয়েছেন দু-দুবার নোবেল, আর কোনও মহিলা আজ পর্যন্ত এই রেকর্ড ভাঙতে পারেননি। তেজস্ক্রিয়তা নামের এক বিশেষ ঘটনা, যেখানে কিছু মৌলের পরমাণু থেকে কয়েক ধরনের অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হতেই থাকে, সেই ঘটনার পেছনে আসলে কী কারণ থাকে, সেটা আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, দু-দুটো তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম আর পোলোনিয়াম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আছে তাঁর।
কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে এত বড় অবদান রাখলেও ব্যক্তি-জীবনে মারি কুরি (Marie Curie) ছিলেন দারুণ দুঃখী একজন মানুষ। এক মোটর দুর্ঘটনায় স্বামী প্রয়াত হয়েছিলেন বিয়ের মাত্র এগারো বছর বাদেই, ছোট-ছোট দুটো মেয়েকে মানুষ করবার গোটা দায়িত্বই যে কারণে এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সীমিত সামর্থ্য আর লোকবল নিয়েও সেই মারি চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, সদ্য আবিষ্কৃত এক্স রশ্মির সাহায্যে ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা করতে এবং অন্যান্য অসুখ-বিসুখে অসুস্থ সেনাদের পাশে দাঁড়াতে।
সব মিলিয়ে আমরা এটাই দেখি যে শুধু তেজস্ক্রিয় রশ্মির চরিত্র বিচার করা বা বিভিন্ন মৌল আবিষ্কারেই তাঁর গবেষণা সীমাবদ্ধ ছিল এমনটা নয় মোটেই। তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে কীভাবে রোগ সারানোর কাজে ব্যবহার করা চলে, তাই নিয়ে বাকি জীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়েছিলেন তিনি। ফ্রান্সের প্যারিসে গড়ে তুলেছিলেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউট। এখানকার সমস্ত কর্মকাণ্ডই পরিচালনা করতেন মারি স্বয়ং।
কিন্তু এর খেসারত তাঁকে অবশ্যই দিতে হয়েছিল। যার সূচনা দেখা যায় ১৯২০ সালে, যখন তাঁর দুটো চোখে তিনি ঝাপসা দেখতে শুরু করেন। মানে তাঁর চোখে ছানি পড়েছিল। আজকের দিনে আমরা জানি যে এটা হয়েছিল কারণ তিনি অতিরিক্ত মাত্রায় তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিয়ে কাজ করতেন। ওই সময় প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রথম মহিলা অধ্যাপক চোখের সমস্যার জন্য নিজে-নিজে বই পড়তে পারতেন না, আর তাঁর লেকচার-নোটসের অক্ষরগুলোও হত বেশ বড় বড়। পরে অবশ্য তাঁর চোখের অপারেশন করা হয়, তিনি আবার আগের মতো পরিষ্কার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিলেন।
আসলে ওই সময়টায় তেজস্ক্রিয় রশ্মির ক্ষতিকর দিক নিয়ে মানুষের কাছে ধারণা মোটেই পরিষ্কার ছিল না। এই রশ্মির প্রভাবে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে শরীরে, তা নিয়ে ধারণা না থাকায় অনেকেই এই রশ্মির প্রভাবে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়তেন। যাঁদের মধ্যে প্রথমেই নাম করা উচিত কুরির। বিশ শতকের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকে তাঁর এই অসুস্থতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শরীর দুর্বল হতে থাকে, আর পরীক্ষা করে জানা যায় যে তাঁর শরীরে নতুন করে কোনও রক্ত-কোষ তৈরি হচ্ছে না। তখন কোনও ডাক্তারই তাঁর এই অসুস্থতার কারণ ধরতে পারেননি। তাঁকে স্বাস্থ্যোদ্ধার করবার জন্য কোনও স্যানাটোরিয়ামে যেতেও বলা হয়েছিল। কোনও চিকিৎসাতেই অসুখ সারেনি তাঁর, ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই তারিখে মাত্র ছেষট্টি বছর বয়সে এক স্যানাটোরিয়ামে মৃত্যু হয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মহিলা-বিজ্ঞানী মারি কুরির। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল ‘অ্যাপ্ল্যাস্টিক পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া’ (Aplastic Pernicious Anemia), পরে যেটার আসল কারণ হিসেবে তেজস্ক্রিয় রশ্মির মধ্যে অতিরিক্ত সময় কাটানোকেই ধরে নেওয়া হয়।
মারি কুরিকে সমাধিস্থ করা হয় জুলাইয়ের ৬ তারিখে, স্কাউক্স নামে একটা জায়গায়, যেখানে আগে থেকেই শায়িত ছিলেন তাঁর স্বামী। কিন্তু এখানেই তিনি যে নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন, তার কি আর জো ছিল? প্রায় ষাট বছর পর তাঁকে ওই সমাধি থেকে তুলে আনা হয়। কারণ? কারণ তিনি যে ফ্রান্সের এক মহান ব্যক্তিত্ব, তাঁকে আরও সম্মানজনক জায়গায় ঠাঁই দেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন- এবার যোগীরাজ্যে পরপর প্রার্থী তুলতে বাধ্য হচ্ছে বিজেপি
১৯৯৫ সালে সেই সমাধি থেকে তাঁর এবং স্বামী পিয়ের কুরি-র কফিন তুলে এনে আরও একবার তাঁদের দেহাবশেষ-সমেত কফিন সমাধিস্থ করা হয় ফ্রান্সের জাতীয় সমাধিস্থল ‘প্যান্থিওন’-এ, যেখানে আগে থেকেই শুয়ে রয়েছেন রুশো, ভিক্টর হুগো বা ভলতেয়ার-এর মতো মহান ফরাসি মনীষীরা। এবারে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে এই সমাধিকে ভরে দেওয়া হয় প্রায় আড়াই মিলিমিটার পুরু সিসার বাক্সে। যাতে ওই দেহ থেকে কোনও তেজস্ক্রিয় রশ্মি বেরিয়ে আসতে না পারে।
শুধু কি সমাধি খুঁড়ে ফেলা? মারি কুরির (Marie Curie) ব্যবহৃত জিনিসপত্রেও অনুসন্ধান চালিয়ে ধরা পড়েছে তেজস্ক্রিয় রশ্মির অস্তিত্ব। যার মধ্যে রয়েছে তাঁর পড়াশুনোর টেবিল, অন্যান্য আসবাব, পোশাক, রান্নার সরঞ্জাম এবং অবশ্যই তাঁর সেই বিখ্যাত ডায়েরিও। যে ডায়েরি আজও বিজ্ঞানী-গবেষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণের জিনিস।
এই ডায়েরিটা রাখা রয়েছে ফ্রান্সের ‘বিবলিওথেক ন্যাশনাল’ নামে একটা প্রতিষ্ঠানে। ওখানে একটা সিল করা সিসার বাক্সের মধ্যে রাখা রয়েছে ওটা। কেন সিসা? কারণ সিসাই হল একমাত্র ধাতু, যে কোনও তেজস্ক্রিয় মৌল ক্ষয় হতে-হতে একসময় এই ধাতুতেই পরিণত হয়। তাছাড়া সিসা পারে বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে (বা গামা এবং এক্স রশ্মিকেও) শোষণ করে নিতে।
মারি কুরির (Marie Curie) ওই ডায়েরির গায়ে লেগে রয়েছে রেডিয়ামের এক আইসোটোপ, যার ভরসংখ্যা ২২৬। আইসোটোপ হল কোনও কোনও মৌল পদার্থের এমন এক বিশেষ রূপ, যে পদার্থের পরমাণুতে মূল মৌলের পরমাণুর মতোই একই সংখ্যক প্রোটন থাকে, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা থাকে আলাদা।
সকলকেই যে এই ডায়েরি দেখতে দেওয়া হয় তা নয়। বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে যাঁরা এই ডায়েরির কাছে যাওয়ার অনুমতি পান, তাঁদের পরতে হয় বিশেষ এক ধরনের পোশাক, এবং একটা জায়গায় লিখে সই করতে হয় এটাই জানিয়ে যে এই কাজের জন্য আমার যা ক্ষতি হবে, তার জন্য আমিই দায়ী।
মারি কুরির ডায়েরিতে লেগে থাকে ওই বিশেষ মৌলের আইসোটোপের অর্ধায়ু কাল ১৬০০ বছর। এর অর্থ হল নির্দিষ্ট পরিমাণ ওই পদার্থের মধ্যে যতগুলো তেজস্ক্রিয় কণা রয়েছে, সেটার সংখ্যা অত বছর পর কমে অর্ধেক হয়ে যাবে। সেই হিসেবে প্রায় ষোলশো বছর পর ওই ডায়েরিতে হাত দেওয়া যেতে পারে, তখন খুব একটা ক্ষতিকর আর থাকবে না ওটা। এমনিতে মারি কুরির জীবনকালের পর প্রায় একশো বছর কেটে গিয়েছে, তাই আর দেড় হাজার পর ওই ডায়েরিতে নিশ্চিন্তে হাত দেওয়া চলবে।
তেজস্ক্রিয় রশ্মি যে কী ভয়ানক হতে পারে তা নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিলেন মারি কুরি, যে কারণেও আজ তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখা উচিত।