কুণাল ঘোষ
-‘সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তৃণমূলেই ফিরব। এবার যতদিন রাজনীতি করব, মমতার নেতৃত্বেই করব।’
লন্ডনের হ্যারোর সেই হোটেলের লাউঞ্জে বসে সুব্রতদার বলা কথাগুলো এখনও কানে বাজছে।
লন্ডনে সেবার চমৎকার একটি অনুষ্ঠান ছিল। মঞ্চে হ্যারোর মেয়র এবং কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের যৌথ সংবর্ধনা। বিলিতি পরিবেশে প্রবাসী কর্মসূচির ফাঁকে কলকাতার রাজনীতির পরবর্তী বাঁকের চর্চা।
তবে সুব্রতদা তখন সিদ্ধান্ত নিলেও বিষয়টা সহজ ছিল না। চটজলদিও কিছু হওয়ার ছিল না। কারণ তৃণমূলের মধ্যে আড়ষ্টতা ও অসন্তোষ ছিল। পাঁচটি বছর তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরসভার মেয়র থাকার পর ভোটের মুখে সুব্রতদার চলে যাওয়া হজম করতে পারেননি কেউই। মমতাদির অভিমানও ছিল তীব্র।
ফলে সুব্রতদার ফেরার সিদ্ধান্ত এবং আসল ফেরার মধ্যে সময় গিয়েছে অনেকটা।
এবং এখানে একটি শর্তও ছিল।
লন্ডনের অনুষ্ঠানে সুব্রতদা যে আছেন, সেটি আমার কলমে কলকাতার কাগজে প্রকাশিত হচ্ছিল।
প্রথম ফোনটাই পাই সাধন পাণ্ডের, যিনি আমাকে হাতের তালুর মতো চেনেন।
-‘ভাই, তুমি কি বিলেত থেকে মেয়র ধরে আনছ?’
ফোনেই অপূর্ব সুরে প্রশ্ন।
বললাম, ‘না না। কী যে বলেন!’
সাধনদা বলেছিলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি সুব্রত ফিরছে।’
এই জল্পনাটা সেসময় বাড়তে থাকে।
এবং চর্চাটা ছিল এইরকম যে সুব্রতদা আবার মেয়র পদ লক্ষ্য করেই আসছেন। কারণ পুরভোট তখন প্রায় এসে পড়েছে।
আজ এখানে কিছু অকথিত অংশ লিখতে কোনও বাধা নেই। বরং আমার মনে হয় বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের স্বার্থে লিখে রাখাই ভাল।
লন্ডনের কথোপকথন আমি স্বাভাবিকভাবেই দিদিকে জানিয়েছিলাম।
পরে ভেবেচিন্তে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে নেত্রী হিসেবে তাঁর এক অসাধারণ উচ্চতা দেখেছিলাম।
-‘বেশ। সুব্রতদা এলে আর আপত্তি নেই। কিন্তু ওঁকে বলে দিও মেয়র পদের জন্য যেন না আসেন। উনি যেসময় যেভাবে চলে গিয়েছিলেন, তাতে এখন আর মেয়র করা যাবে না। পার্টির বাকিরা দুঃখ পাবে। তবে ভরসা রেখে যদি আসেন, ভবিষ্যতে ওঁর সম্মান আর কাজের দায়িত্ব আমার।’
কঠিন কথা। স্পষ্ট কথা।
আরও কঠিন সুব্রতদাকে আমার এটা বলা।
বললাম। বুঝিয়ে।
এখানেই আবার আবিষ্কার করলাম আরেক সুব্রতদাকে। ভেবেছিলাম একটু গম্ভীর হবেন। কোথায় কী!
-‘মেয়র? দূর! ওসব আমি ভাবছিই না। ওই চ্যাপ্টার ক্লোজড। আরে আমি ছাব্বিশ বছর বয়সে মানুদার মন্ত্রী। পদ-টদ নিয়ে এই বয়সে আর ভাবি না। আমি পলিটিক্সটা করতে চাই। এর বেশি কিছু না। আর মমতার উপর ভরসা না থাকলে ওর কাছেই ফিরছি কেন?’
এরপর কোনও কথা হয় না।
অতঃপর প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত পাকা।
কাউকে বলা হয়নি।
কিন্তু এটা হবে কবে?
মমতাদি বললেন, ‘জানাব।’
অতএব অপেক্ষা।
শেষমেশ দিনটি এল।
সিঙ্গুরে দিদির কর্মসূচি। বিকেলে সভা। ঠিক হল চমক দেওয়া হবে। দিদি, সোমেনদা তো থাকবেনই। সুব্রতদা যোগ হবেন। প্রথমে দিদির বাড়ি যাবেন তিনি। তারপর দিদির সঙ্গেই সিঙ্গুর।
আগের রাত পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। সকালে আরেক মজা।
সেদিন মেঘ, বৃষ্টি।
সুব্রতদার সাড়ে এগারোটায় মমতাদির বাড়ি যাওয়ার কথা। ওঁরা বারোটায় বেরোবেন। আমি আর ওদিকে যাইনি।
প্রথমে দিদি একবার ফোন করলেন, ‘সোমেনদা আলাদা রওনা হয়ে যাচ্ছেন। ওঁকে আমার এখানে আসতে বলো। আগেই সুব্রতদার বিষয়টা বলে রাখি। না হলে কিছু মনে করতে পারেন।’
সোমেনদাকে ফোনে ধরলাম। তখন দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার হয়ে গিয়েছেন। বললাম, ‘গাড়ি ঘোরান। দিদির বাড়ি যান। একসঙ্গে বেরোবেন।’
সোমেনদা আমাকে কারণ জিজ্ঞেস করতে আমি বলেছিলাম কী করে জানব। উনি সবটাই তারপর বুঝেছিলেন। মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘তখন বললে কী হত? আমি কি সুব্রতকে আটকাতে যেতাম?’
যাই হোক, ঘটনার বাকি ছিল তারপর।
মমতাদির ফোন, ‘আরে সুব্রতদা কোথায়?’
আমি ফোন করলাম সুব্রতদাকে।
-‘কোথায় আপনি? যাননি?’
-‘বাড়িতে। রেডি হয়ে বসে আছি।’
-‘সে কী! যাচ্ছেন না কেন?’
-‘আরে কেমন একটা লজ্জা করছে, দ্বিধা আসছে।’
লজ্জা! দ্বিধা!
সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলছেন!
আমার তো মাথায় বাজ।
-‘কেন দাদা কী হল?’
এর উত্তরে সুব্রতদা যা বললেন, তার মোদ্দা কথা হল : ওঁর সঙ্গে মমতাদির এতদিনের এত ভাল সম্পর্ক ছিল। অথচ পাঁচ বছর মেয়র থাকার পর উনি ভোটের মুখে দল ছেড়ে গিয়েছিলেন। এখন আবার মমতাদির কাছে যেতে সঙ্কোচ বোধ করছেন।
শিশুর সারল্যে বললেন, ‘একা একাই তো যাচ্ছিলাম। কিন্তু কেমন যেন লাগছে? তুমি আসবে একবার?’
-‘দাদা আমি বাড়িতে। বৃষ্টি পড়ছে। জ্যাম থাকবে। যেতে সময় লাগবে। মমতাদি ওদিকে রেডি হয়ে বসে আছেন। আপনি গেলেই বেরোবেন। আপনি শিগগির যান।’
-‘তাহলে আজ থাক, আরেকদিন যাই?’ সুব্রতদা গুটিয়ে যাচ্ছেন।
– ‘না না। আজই যাবেন। দাঁড়ান আমি আসছি।’
অতঃপর উত্তর কলকাতার রামমোহন রায় রোড থেকে সটান গড়িয়াহাট।
মমতাদিকে জানালাম।
দিদি আর সোমেনদা তখন অপেক্ষায়। ওদিকে রওনা হতে দেরি হচ্ছে।
গড়িয়াহাট গিয়ে দেখি সুব্রতদা বাড়ির বসার ঘরে একা বসে।
-‘কেমন একটা দ্বিধা লাগছে। ওই সময় তোমরা অতবার বারণ সত্ত্বেও আমি তৃণমূল ছেড়ে গিয়েছিলাম। আমার মুখ থেকে খারাপ কথাও বেরিয়েছে। আজ আবার আমার রাজনীতির জন্য যাচ্ছি। এটা ওরা কেমনভাবে নেবে?’
দেখলাম সুব্রতদা আবেগতাড়িত আছেন। বললাম, ‘মমতাদি মন খুলেই আপনাকে দলে নিচ্ছেন। কেন এসব ভাবছেন?’
একটু সময় লাগল।
সুব্রতদা ঠিকঠাক হলেন। বললেন, ‘একটা সময় ছিল, আমি নেতা। মমতা কর্মী। আমি ১৯৮৪ সালের লোকসভায় যাদবপুরে আমাদের প্রার্থী হিসেবে ওর নাম বলেছিলাম। আর এখন সত্যিই ও নেত্রী। ও নিজেকে তৈরি করেছে, প্রমাণ করেছে। এককালে আমি গুরু ছিলাম। ও শিষ্যা। আজ ও নেত্রী। আমি কর্মী। আমার গর্ব লাগে মেয়েটার জন্য। আর মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ার জন্য অপরাধী লাগছে। দেখে নিও, আমি যতদিন বাঁচব ওর নেতৃত্বেই চলব।’
সুব্রতদাকে সেদিন আমার কখনও মনে হচ্ছে এক বিবেকদংশিত রাজনীতিবিদ, কখনও মনে হয়েছে সারল্যে ভরা শিশু, কখনও মনে হয়েছে সন্ন্যাসী।
শেষে বললেন, ‘একা যাব না। তুমি চলো মমতার বাড়ি পর্যন্ত।’
যাই হোক, শেষমেশ সুব্রতদাকে নিয়ে বেরোলাম। সুব্রতদার গাড়িতেই।
দেরি দেখে ব্যস্ত হয়ে মমতাদি তখন সোমেনদাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছেন। বাড়ির উঠোন থেকে বেরিয়ে গাড়ি ও কনভয় দাঁড়িয়ে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে।
বৃষ্টি পড়ছে।
আমরা পৌঁছলাম। তুমুল ভিড় এবং অপেক্ষা। সবাই বুঝছেন কেউ আসবেন, কিন্তু তিনি ঠিক কে, অধিকাংশই জানতেন না।
বৃষ্টির মধ্যেই কোনওভাবে সুব্রতদাকে এই গাড়ি থেকে নামিয়ে দিদির গাড়িতে তুলে দিয়ে আমার ছুটি।
সুব্রতদা, সোমেনদাকে নিয়ে দিদি সিঙ্গুর রওনা হয়ে গেলেন। আমি গেলাম অফিসের দিকে।
সেই যে সুব্রতদা তৃণমূলে ফিরেছেন, আমৃত্যু তিনি মমতাদির বিশ্বস্ত সহকর্মী। আনুগত্যের সঙ্গে তৃণমূল করেছেন।
সেদিন সিঙ্গুরে অবশ্য শুরুটা একটু বিঘ্নিত ছিল। সুব্রতদাকে দেখে কট্টর তৃণমূল কর্মীদের একাংশ বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছিল।
মমতাদি আগলে রেখেছিলেন। এই পর্বটি ভাল বলতে পারবে সাংবাদিক শ্রীমান বিতনু চট্টোপাধ্যায়।
তবে তার পরে আর কোনও সমস্যা হয়নি।
* * * * * * * * * * * *
এই সূত্রে আমি সুব্রতদার আরেকটি দিক নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে চাই।
তা হল টিমম্যানশিপ।
হয়তো দলবদল করেছেন। কিন্তু যখন যে টিম করেছেন, মন দিয়ে করেছেন।
এবং জুটি বেঁধে করেছেন।
যেমন প্রিয়দা-সুব্রতদা।
দুরন্ত জুটি।
ছাত্রজীবনে স্বপন মুখোপাধ্যায়ের (পরে সাংবাদিক) হাত ধরে রাজনীতিতে আসা।
তারপর থেকেই তো প্রিয়দার সঙ্গে। রাম-লক্ষ্মণ। একসঙ্গে থাকা, খাওয়া, রাজনীতি।
ছন্দবাণীদির সঙ্গে প্রেম করতে যেতেন প্রিয়দার পাঞ্জাবি পরে। সেটা সুব্রতদার একটু ছোট হতে বলে হাত গুটিয়ে পরতেন। সেই অভ্যেস থেকে গিয়েছে আমৃত্যু।
প্রিয়-সুব্রত জুটি প্রবাদপ্রতিম।
সুব্রতদা কখনও প্রিয়দাকে অতিক্রমের চেষ্টা করেননি।
সোমেনদা যখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, তখন কিছুটা সময় সুব্রতদা সহসভাপতি। হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারের অফিসে সভাপতির বাঁদিকে তিনি বসতেন। অতীতের রেষারেষি ভুলে তখন তিনি টিম-সোমেনের দু’নম্বর। সোমেনদা নির্ভর করতেন। সুব্রতদা কখনও একনম্বর হওয়ার চেষ্টা করেননি।
মমতাদির ক্ষেত্রেও তাই। বিশেষ করে শেষ দশ-বারো বছর। পুরোপুরি টিমম্যান। যখন যে ভূমিকায় দল খেলতে বলেছে, খেলেছেন। অভিভাবকোচিত ভূমিকায় নিয়ে গিয়েছেন নিজেকে।
অর্থাৎ, জুটিতে খেলতে জানতেন। নিজেকে একধাপ পিছিয়ে রেখেও জুটির স্বার্থে প্রাণখুলে খেলতেন।
এটা এক বিরল দিক।
আবার বিবেক বা নিজস্ব সিদ্ধান্তে ঝুঁকি নিতেও পিছপা হতেন না।
বড় উদাহরণ, প্রিয়দাকেও একসময় ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীকে ছাড়েননি।
কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছিলেন তখন, যখন তাঁর নিজের ব্যাখ্যায়, ‘মমতাই তো এখন আসল কংগ্রেস। আর ইন্দিরাজি, রাজীবজিকে তো মমতাও শ্রদ্ধা করে।’
সুব্রতদা একটা সময় দলত্যাগী প্রিয়দার সঙ্গে না গেলেও দু’জনের সম্পর্ক ছিল দেখার মতো। টান, আন্তরিকতা, খুনসুটি সবকিছু মেশানো। কিছু রাজনৈতিক বিরোধ এলেও বুঝতাম সেটা উপরে, হৃদয়ের অন্তস্তলে গিয়ে পৌঁছয় না।
পরে আমাদের ক্লাব রামমোহন সম্মিলনীর দুর্গাপুজোয় একবার একসঙ্গে প্রিয়দা- সুব্রতদাকে আমন্ত্রণ করেছিলাম। তখন প্রিয়দা কেন্দ্রে ইউপিএ-র মন্ত্রী আর সুব্রতদা কলকাতায় তৃণমূলের মেয়র। বহুদিন পর একসঙ্গে মঞ্চে।
সেদিন ভাষণপর্বের আগে এবং পরে যে আড্ডাটি হয়েছিল, তা ভারী মর্মস্পর্শী এবং ইতিহাসবাহী।
দুই নক্ষত্র তাঁদের সেই বিচ্ছেদপর্বের গল্প শোনাচ্ছিলেন।
প্রিয়দারা কংগ্রেস ছাড়ছেন।
সুব্রতদা ইন্দিরাজিকে ছাড়বেন না।
দাদা- ভাই দুই পথে যাচ্ছেন।
সেই সময়ের মনখারাপের গল্প।
সুব্রতদা অনেক কিছু পেয়েছেন।
আবার অনেক কিছু পাননি।
যেমন সবরকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোনওদিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হননি। আইএনটিইউসি সভাপতি হয়ে থাকতে হয়েছে।
তিনি এতদিনের বিধায়ক। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু বিরোধী দলনেতা হননি।
সুব্রতদা আইএনটিইউসির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। কিন্তু সভাপতি হননি।
তিনি বিধায়ক, মন্ত্রী, মেয়র হয়েছেন। কিন্তু লোকসভা বা রাজ্যসভায় কখনও যেতে পারেননি।
সুব্রতদা এমনিতে দিল্লিতে থেকে দিল্লিভিত্তিক রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তাঁর পছন্দ ছিল কলকাতা। যে কারণে আইএনটিইউসির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদটাও মন থেকে উপভোগ করতে পারেননি। বলতেন—‘দূর। দিল্লিতে পোষাবে না। কাজের বাইরে কিছু করার নেই। আড্ডা মারার লোক নেই। পিছনে লাগার লোক নেই। আমার কলকাতাই ভাল।’
তবে হ্যাঁ, লোকসভা বা রাজ্যসভায় একটিবার যেতে পারলে হয়তো ফাঁক থাকত না কোনও। তৃপ্ত হতেন সুব্রতদা। তাঁর অবচেতনে এটা ছিল একটি অসম্পূর্ণতা।
রাজ্যসভা নিয়ে একবার গভীর রাতে একটা কাণ্ড হয়েছিল।
(এরপর আগামিকাল)