শুধু কি বিপদ? নাহ্ একেবারে মহাবিপদ হতে পারত পৃথিবীর এই গোটা সৃষ্টি ও সভ্যতার জন্য; তবে আপাতত সেই সম্ভাবনা আর নেই। আমরা কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞানীমহলে শুরু হয়েছে জোর জল্পনাকল্পনা; তাঁদের কাছে এ এক অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগ! বিপদবহুল গ্রহাণু ধরিত্রীর বুকে আছড়ে না পড়লেও পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসবে এই অ্যাপোফিস অ্যাস্টারয়েডটি (asteroid), যাকে খালি চোখেই দেখা যাবে। আমাদের বাসযোগ্য গ্রহের প্রত্যক্ষ ঝুঁকি এখন নিতান্তই একটি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল!
নিয়ার আর্থ অবজেক্টস ও তাদের প্রভাব
আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বৎসর আগে আমাদের সৌরজগৎ সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে সৃষ্ট বহুসংখ্যক বিক্ষিপ্ত বস্তু বা বস্তুপিন্ড আজও ওই মহাশূন্যে সূর্যকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ঘুরছে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্বের প্রায় ১.৩ গুণ দূরত্বে অবস্থান করছে এবং পৃথিবীর উপর যেকোনও সময় আকস্মিকভাবে বিপদ ডেকে আনতে পারে, এদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘নিয়ার আর্থ অবজেক্ট’ বা ‘নিও’। সৌরজগতের মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যবর্তী কক্ষপথে এদের দেখা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিভিন্ন অ্যাস্টারয়েড বা গ্রহাণু এবং কমেট বা ধূমকেতু। অ্যাপোফিস হল এইরূপ বিপদবহ একটি অ্যাস্টারয়েড বা গ্রহাণু। ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল আ্যাস্টারয়েড ওয়ার্নিং নেটওয়ার্কে’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘দ্য ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার’ যৌথভাবে এইসব ‘নিয়ার আর্থ অবজেক্ট’দের শনাক্তকরণ, তাদের গতিপ্রকৃতি এবং পৃথিবীতে আঘাত হানার প্রবণতার উপর নজর রাখে। এইসব গ্রহাণু বা ধূমকেতুরা চওড়ায় এক থেকে কয়েক দশক কিলোমিটার হয়ে থাকে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অমর (৪৩৩ এরস) অ্যাস্টারয়েড’ নামে একটি নিয়ার আর্থ অবজেক্ট আবিষ্কৃত হয়েছিল, যার আনুমানিক আকার প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। মনে করা হয় এই গ্রহাণুটি অন্তরীক্ষে ভাসমান বৃহত্তর আকারের অ্যাস্টারয়েডগুলোর মধ্যে একটি।
সৌরজগতের মধ্যে ঘূর্ণায়মান এইসকল অ্যাস্টারয়েড (asteroid) বা কমেটগুলো তাদের নিকটবর্তী গ্রহের কেন্দ্রস্থ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পৃথিবীর প্রতিবেশী অঞ্চলে ঢুকে পড়ে এবং পৃথিবীর সঙ্গে টক্করের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সাধারণত এই গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতুগুলো ধূলিকণাযুক্ত জল, বরফ ও নুড়ি দিয়ে তৈরি হয়। এ-বছরের ২০ জানুয়ারি অবধি আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অন্তর্ভূক্ত ‘সেন্টার ফর নিয়ার আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজ’-এর তথ্য অনুযায়ী ওই মহাকাশে আনুমানিক প্রায় ৩৪২৬৬টি ‘নিও’ রয়েছে; তাদের মধ্যে মাত্র ১২৩টি ধূমকেতু এবং বাকি ৩৪১৪৩টিই অ্যাস্টারয়েড (asteroid), যার মধ্যে ২৩৯৬টি আবার পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ! এদের মধ্যে অ্যাপোফিস অ্যাস্টারয়েডটিও অন্যতম ছিল। তবে নিসর্গবিদদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে অ্যাপোফিসজনিত বিপদ কেটে গেছে। কেননা, আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধানে সাম্প্রতিক সময়ে যে-সকল গ্রহাণু মারাত্মকভাবে পৃথিবীর উপর আঘাত হানতে পারে তাদের উপর নজরদারির জন্য নিরূপিত ‘দ্য সেন্ট্রি ইম্প্যাক্ট রিস্ক টেবিলে’র ১৭০৪টি প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাস্টারয়েডের তালিকার বাইরে অবস্থান করছে অ্যাপোফিস।
আরও পড়ুন- দোলে ভিড় উপচে পড়ল শান্তিনিকেতনে, কবে বিশ্বভারতীতে বসন্ত উৎসব
অ্যাপোফিস ও তার বৈশিষ্ট্য
অ্যাপোফিস হল একটি দীর্ঘাকার দ্বিপ্রান্তিক অ্যাস্টারয়েড (asteroid) বা গ্রহাণু; যেটা একটি চিনাবাদামের মতো দেখতে, পাথুরে এবং সিলিকা, লোহা এবং নিকেলের মতো ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অভিধানে এই গ্রহাণুটি ‘অ্যাস্টারয়েড ৯৯৯৪২’ হিসেবে চিহ্নিত। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুন অ্যারিজোনার টাকসান প্রদেশের দ্য কিট পিক ন্যাশনাল অবজারভেটরিতে কর্মরত মহাকাশ বিজ্ঞানী রয় টুকার, ডেভিড থাইলেন এবং ফ্যাব্রিজিও বার্নার্ডি সর্বপ্রথম এই গ্রহাণুটিকে শনাক্ত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত সেইদিন ওই বিজ্ঞানীত্রয় বিভিন্ন প্রাযুক্তিক এবং আবহাওয়াজনিত কারণে মাত্র দু ঘণ্টার বেশি সময় ওটাকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হননি। তবে ওই বছরই অস্ট্রেলিয়ার দ্য সাইডিং স্প্রিং অবজারভেটরি অ্যাপোফিসকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। এই অ্যস্টারয়েডটির এইরূপ বিশেষ নামকরণ প্রাচীন মিশর পুরাণের সেই বিখ্যাত দানব বিছের নামানুসারে রাখা হয়েছে, যাকে দুষ্ট এবং বিশৃঙ্খলার প্রতীক মনে করা হত। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই গ্রহাণুটিরও পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ার ব্যাপক সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু অন্তত এক শতকের জন্য বিপদ কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
নাসার ওয়েবসাইটের ‘সেন্ট্রি ইম্প্যাক্ট রিস্ক’ পেজে উল্লেখিত ১৭০৪টি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাস্টারয়েডের মধ্যে ১০৫টি বাদে বাকি সবগুলো চওড়ায় প্রায় ৫০ মিটারের মধ্যে। বৃহদাকার গ্রহাণু যারা চওড়ায় প্রায় ৬০০ ফুটের বেশি তারা খুব সাধারণত ইংরেজি বর্ণমালার ‘এস’ অক্ষরের মতো দ্বিপ্রান্তিক হয়ে থাকে। দেখা গেছে আকারে বড় এমন প্রতি ৬টি অ্যাস্টারয়েডের মধ্যে ১টির অবশ্যই দুটি নির্দিষ্ট প্রান্ত রয়েছে। অ্যাপোফিস চওড়া প্রায় ৩৩৫ মিটার যা প্রায় ১১০০ ফুটের সমান। স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রহাণুটিও দুটি প্রান্ত বিশিষ্ট। অনেক দিন যাবৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও এই গ্রহাণুটির সেইরকম কোনও স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব হয়নি; তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অ্যাস্টারয়েড অ্যাপোফিস সৌরজগতের অন্য এক অ্যাস্টারয়েড ‘ইটোকাওয়া’র মতো প্রায় দেখতে। ইটোকাওয়া হল প্রথম গ্রহাণু যার নমুনা সংগ্রহ করে আনা হয়েছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে।
আশার আলো
যদিও মনে করা হচ্ছিল অ্যাস্টারয়েড অ্যাপোফিস পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসছে, তবুও হিসেব করে দেখা গেছে বর্তমানে সেটি এখনও পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০.৬ মিলিয়ন মাইল অর্থাৎ ১৭ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। পৃথিবীর উপর এই গ্রহাণুর ভয়ঙ্কর প্রভাবের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান ২০২৯ সালে যে মহাবিপদের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সেটা আর নেই। ওই বছর পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এলেও অ্যাপোফিস কোনও প্রকার আঘাত করবে না। আমেরিকার নাসার প্ল্যানেটরি ডিফেন্স কো-অর্ডিনেশন অফিসের আয়ত্তাধীন ‘দ্য সেন্টার ফর নিয়ার আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজ’-এর উন্নত অপটিক্যাল টেলিস্কোপের ‘গ্রাউন্ড বেসড রেডারে’র উচ্চগুণসম্পন্ন হিসেব অনুযায়ী এই গ্রহাণুটি ‘সেন্ট্রি’ সূচকের বিপদসীমার বাইরে অবস্থান করছে অন্তত আগামী একশো বছর। উন্নত প্রযুক্তির উপর ভর দিয়ে করা এই নিবিড় গবেষণার ফল হিসেবেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সমগ্র পৃথিবীর মানবজাতির কাছে এই সুখবর পৌঁছে দিয়েছেন, যা সত্যিই স্বস্তির কারণ! (শেষ পর্ব আগামী সপ্তাহে)