আল্ব্রেখট গোৎসে ছিলেন ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর দশকের জার্মানির মারবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতিমান জার্মান অধ্যাপক। তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত ছিলেন। তাঁর পিতা রুডলফ গোৎসে গবেষণাধর্মী কাজ করতেন সিগমন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে। আল্ব্রেখট গোৎসে ১৯৩৩-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশ্য বিরোধিতায় নামে নাৎসিদের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালিখির মাধ্যমে নাৎসিদের বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। সেই নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নাৎসিরা তাঁকে অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন, শুধু এটুকুতেই সীমিত নয়, নাৎসি দলের উন্মত্ত সদস্যরা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাঁর বাড়ির জানালায় পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। তিনি ও তাঁর পরিবার অল্প সময়ের মধ্যেই জার্মানি ত্যাগ করেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পেশা গ্রহণ করে সেখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। আল্ব্রেখট গোৎসে একটি উদাহরণ মাত্র সেই সময় অসংখ্য শিক্ষক, অধ্যাপক জার্মানি ত্যাগ করেছিলেন নাৎসিদের অত্যাচারের আতঙ্কে, যাঁরা রয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের অবস্থাও সংকটাপন্ন হয়ে যায়। ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর অ্যাডলফ হিটলার চেয়েছিলেন জার্মানির শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে তাদের রাজনৈতিক যে স্থায়িত্ব তাকে পাকাপাকি করে নিতে। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বার্নহার্ড রাস্ট সেই সমস্ত শিক্ষক যাঁরা নাৎসি মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় তাঁদের কর্মচ্যুত করে দিয়েছিলেন, পাঠ্যক্রমের আমূল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল, সেখানে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল নাৎসি মতাদর্শকে। শিক্ষার (Education) সাথে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত উচ্চপদে নাৎসি মতাদর্শপন্থীদের বসানো হচ্ছিল, আসলে সমস্ত একনায়কতন্ত্রীদের লক্ষ্য থাকে শিক্ষা ক্ষেত্রকে অধিগ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই সমস্ত ভ্রান্ত মূল্যবোধকে প্রোথিত করে দেওয়া যাতে তারা একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন না তুলতে পারে, একনায়কতন্ত্রের আনুগত্যতাকে স্বীকার করে নেয়।
আরও পড়ুন- বঞ্চিত জবকার্ড হোল্ডারদের জন্য নয়া উদ্যোগ রাজ্যের, এবার মিলবে ৬০ দিনের কাজ
সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণকারী একনায়কতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের দুটি মাধ্যম থাকে একটি হল বল প্রয়োগ— কেন্দ্রীয় পুলিশ, কেন্দ্রীয় এজেন্সি, আধা সেনাবাহিনীর দ্বারা বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়া, অপরটি হল মতাদর্শগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেখানে প্রশ্নহীনভাবে মানুষ একনায়কের কর্তৃত্বকে মেনে নেয়। দার্শনিক অ্যান্টনিও গ্রামশিকে মনে পড়ে, তিনি দেখিয়েছিলেন ‘ডমিনেশন’ ও ‘হেজেমনি’-এর পার্থক্যকে, ‘হেজেমনি’ হল সেই কর্তৃতকারী মতবাদ যা চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে অবদমনের আস্ফালন থাকে না, নিভৃতে মানুষের মনে জায়গা করিয়ে দেওয়া হয় মতবাদকে। কিছু মাধ্যম সেক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নেয়, যেমন— সিনেমা, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, সোশ্যাল মিডিয়া। একনায়কতান্ত্রিক সরকার সুক্ষভাবে কবজা করে এই মাধ্যমগুলোকে।
আশ্চর্য রকমের মিল আমাদের দেশের বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে হিটলার শাসিত ১৯৩৩-এর পরবর্তী জার্মান সরকারের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক স্থাপিত স্ট্যাটুটারি সংস্থা ইউজিসি গত বছর একটি নতুন নিয়ম প্রণয়ন করেছে, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রফেসর অফ প্র্যাক্টিস’ নামক একটি পদ তৈরি করতে হবে এবং সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা পারদর্শী, খ্যাতনামা মানুষ তাদের নিয়োগ করতে হবে, এর জন্য কোনও প্রবেশিকা পরীক্ষা পিএইচডি বা সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নয় । সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই পদে অতুল কোঠারিকে নিয়োগ করেছে, যে অতুল কোঠারি বিজেপির মুখ্য পরিচালিকা শক্তি আরএসএসের দীর্ঘদিনের প্রচারক হিসাবেই খ্যাত। সমভাবে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠানে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আরএসএসের মতাদর্শপন্থী শান্তিশ্রী পণ্ডিত, যিনি প্রকাশ্যেই বলেন, ‘আমি আমার মূল্যবোধ আরএসএস-এর থেকেই পেয়েছি এবং আমি গর্বের সাথেই বলি যে আমি আরএসএসের সাথে যুক্ত এবং আমি একজন গর্বিত হিন্দু।’
এনসিআরটি হল কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের স্বশাসিত সংস্থা যার অন্যতম কাজ হল দেশের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমের একটি কাঠামো তৈরি করা। ২০২৩ সালে এই সংস্থা স্কুলের পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে।
(এরপর আগামিকাল)