বিপদসীমার বাইরে অ্যাপোফিস

অ্যাস্টারয়েড জগতে অ্যাপোফিস খুব তাড়াতাড়িই কুখ্যাতি অর্জন করেছিল, পৃথিবীর উপর মারাত্মক সঙ্কট বয়ে আনতে পারে এই ভেবে, তবে সেটা আগামী ১০০ বছরের মধ্যে নয়। এই বিষয়েই আলোকপাত করছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ৷ (শেষ পর্ব)

Must read

প্রসঙ্গ
বৃহত্তর আকারের এবং পৃথিবীর উপর আঘাত হানতে পারে এমন উচ্চঝুঁকিপূর্ণ অ্যাস্টারয়েডগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বৈজ্ঞানিকভাবে আলোচিত গ্রহাণু হল অ্যাপোফিস (Apophis)। প্রায় ১.১ কিলোমিটার আকারের এই অ্যাস্টারয়েডটি নিকট ভবিষ্যতে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারত বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় জ্যোতির্বিদরা সেই সম্ভাবনাকে প্রায় নস্যাৎ করেছেন।
বিজ্ঞানীদের চর্চায় উঠে এসেছে, এই গ্রহাণুটির আগামী ২০২৯ খ্রিস্টাব্দে, তারপর ২০৩৬ খ্রিস্টাব্দে এবং পুনরায় ২০৬৮ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা ছিল। তবে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন আগামী একশো বছরের মধ্যে এইরূপ সম্ভাবনা সত্যি হবে না। গ্রহাণুটি পৃথিবীর খুব কাছে এসে একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পাশ দিয়ে চলে যাবে, কোনও প্রকার টক্করের ভয় নেই। আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘সেন্টার ফর নিয়ার আর্থ অবজেক্ট স্টাডিজ’-এর বিজ্ঞানী ডেভিড ফার্নোকশিয়া একথা জোর দিয়ে জানিয়েছেন।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ
প্রথম থেকেই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অ্যাপোফিস; নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হত এই গ্রহাণুটির কক্ষপথীয় গতি ও তার প্রকৃতি। বিজ্ঞানী মহলে খবর ছিল অ্যাপোফিসের অন্তরীক্ষ গতিবিদ্যার হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে; এই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখে এই গ্রহাণুটির সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করতে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল ‘রেডার অবজারভেশন ক্যাম্পেইন’। ঠিক ওই বছরই মার্চ মাসের ৫ তারিখ দেখা যায় অ্যাপোফিসের কক্ষপথীয় গতিবেগের পরিবর্তন হয় এবং হঠাৎই পৃথিবী থেকে সামান্য দূরে অবস্থান করছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই সুযোগটি দারুণভাবে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন আগামী একশো বছরের মধ্যে অ্যাপোফিসের (Apophis) পৃথিবী আক্রমণের সম্ভাবনার আরও সুক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করতে। অতঃপর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
এই শক্তিশালী রেডার পর্যবেক্ষণের জন্য বিজ্ঞানীরা ক্যালিফোর্নিয়ার বারস্টোতে অবস্থিত দ্য ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের ‘গোল্ডস্টোন ডিপ স্পেস কমিউনিকেশনস কমপ্লেক্স’-এ লাগানো একটি ৭০ মিটার দৈর্ঘ্যের (প্রায় ২৩০ ফুট) রেডিও অ্যান্টেনা ব্যবহার করেছিলেন। পর্যবেক্ষণ শেষে অ্যাপোফিসের ভবিষ্যৎ গতিপথ সঠিকভাবে নিরূপণ করার পর দেখা যায়, এই গ্রহাণুটি আগামী ২০২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল পৃথিবীর অত্যন্ত কাছে চলে আসবে। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে একটি জিওসিঙ্ক্রোনাস স্যাটেলাইটের চেয়েও কম দূরত্বে, মাত্র ৩২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করবে এই অ্যাস্টারয়েডটি। ওই সময় পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধে গ্রহাণুটিকে কোনওপ্রকার টেলিস্কোপ কিংবা বাইনোকুলার ছাড়াই খালি চোখে দেখা যাবে; এই নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের শেষ নেই।

আরও পড়ুন- শিক্ষার অঙ্গনে গেরুয়া উৎপাত

সাম্প্রতিক গবেষণা
এ-বিষয়ে সম্প্রতি গত ৩ মার্চ আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ইথাকা শহরে অবস্থিত কর্নেল ইউনিভার্সিটির সুবিখ্যাত ডিজিটাল গবেষণাপত্র প্রকাশিত প্লাটফর্ম ‘আর্ক্সিভ’-এ আরও একটি উচ্চ তত্ত্বাবধানশীল গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন দ্য ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওর অধ্যাপক বিজ্ঞানী পল উইজার্ট এবং দ্য ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটার্লুর অধ্যাপক বিজ্ঞানী বেন হায়াত। উভয়েই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগে কর্মরত। তাঁরাও এ-কথাই দাবি করেন যে অ্যাপোফিসের জন্য হয়তো এখন আমাদের কোনওপ্রকার বড় বিপদের সম্ভাবনা নেই, তবে বেশ কিছু অতিরিক্ত সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন।
তাঁরা জানান যে, পৃথিবীর উপর অ্যাপোফিসের (Apophis) ব্যাপক প্রভাবের কথা ভেবেই তাঁরা এই গ্রহাণুটির উপর বিগত ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন এবং এই পর্যবেক্ষণ আগামী ২০২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। ইতিমধ্যেই তাঁরা অ্যাস্টারয়েড-আর্থ সংঘর্ষের নানা ধরনের সুযোগ এবং সম্ভবনা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের ধারণা এই গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সরাসরি টক্কর না হলেও মূল অ্যাস্টারয়েড বেল্টে ঘূর্ণায়মান গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনাও প্রবল যা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর ক্ষতি করবে। এ-ছাড়াও সৌরজগতে ঘূর্ণায়মান অস্থিতিশীলতা, বিকিরণজনিত চাপ, তাপীয় ভগ্নাংশ এবং জল-বরফের ঊর্ধ্বপাতনের ফলে সৃষ্ট ভাসমান দ্বিমুখী মহাজাগতিক নুড়ি, পাথর ও অন্যান্য বস্তুর সঙ্গেও টক্করের সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁরা আরও জানিয়েছেন যে, কোনওরকম সংঘর্ষ না হলেও পৃথিবীর উপর এই গ্রহাণুটি আছড়ে পড়তে পারে যদি অন্য কোনও পার্শ্ববর্তী গ্রহাণুর মাধ্যাকর্ষীয় শক্তির টানে অ্যাপোফিসের গতিবেগের কোনও পরিবর্তন দেখা দেয়।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি এইরূপ ঘটনা এই বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অ্যাপোফিসের গতিবিধির উপর। গত ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাস্টারয়েড ২’ একটি ছোট আকারের বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাস্টারয়েড ৫৯৬’ সহেইল্যা একটি ৩৫ মিটার আকারের বস্তুর সঙ্গে টক্কর লাগে। এইরকম ছোট-বড়-মাঝারি গ্রহাণু এবং ধূমকেতুর সঙ্গে অ্যাপোফিসের (Apophis) সংঘর্ষের সম্ভবনা ২০২৯ খ্রিস্টাব্দের আগে বহুবার রয়েছে। হয়তো সেই সম্ভাবনা ২ শতাংশ, হয়তো কোনও বিপদ ঘটবেই না, তবুও বিজ্ঞানীদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে এর উপর। এই দু’জন বিজ্ঞানী নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি এবং ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির নিয়ার আর্থ অবজেক্টস ডিনামিক সাইটের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বেশকিছু আগাম সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন।
গত বছর অগাস্ট মাসে অ্যাপোফিসের সঙ্গে ‘অ্যাস্টারয়েড ২০১৬ এফ বি ১২’ গ্রহাণুর সংঘর্ষের একটি ২% সুযোগ তৈরি হয়েছিল যেটা কেটে গিয়েছে; তবে আগামীদিনে ‘অ্যাস্টারয়েড ২০০৯ জে জি ২’-এর সঙ্গে টক্করের ২% সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আগামী ২০২৫ সালে অ্যাপোফিসের সঙ্গে ‘অ্যাস্টারয়েড ২৫১৪৩’ ইটোকাওয়ার এবং ওই বছরই মে মাসে প্রথমবারের জন্য ‘অ্যাস্টারয়েড ২০২২ কে এন ৩’-এর সঙ্গে এবং পুনরায় দ্বিতীয় বারের জন্য ২০২৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে সংঘর্ষ হতে পারে। তবে ২০২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ‘অ্যাস্টারয়েড ২০০১ এফ বি ৯০’-এর ব্যাপারটিও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে সংঘর্ষ-সম্ভাবনাটি বিজ্ঞানীদের চিন্তায় ফেলেছে সেটি হল অ্যাপোফিসের চেয়ে প্রায় ২৫ গুণ বড় গ্রহাণু ‘অ্যাস্টারয়েড ৪৫৪৪’ জ্যান্থাসের ধাক্কা! সম্ভাব্য তারিখ ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৬। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে জ্যান্থাসের অনুরূপ গ্রহাণু ‘অ্যাস্টারয়েড ২০১৬ সি এল ১৮’-এর সম্ভাব্য টক্করের ব্যাপারটিও নজর কেড়েছে। এ-ছাড়াও রয়েছে ওয়েলস, মেলিশ, স্কোয়ামশ, সেকি, সুচিয়া-কিউচি, স্বোয়ান, এবং অ্যাটলাস নামে সাতটি ধূমকেতুর সঙ্গে টক্করের সম্ভাবনা। প্রকৃতি তাঁর নির্দিষ্ট নিয়মে চলে, কী হতে পারে সে-সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, তাঁদের নিরলস গবেষণার পর এটা তাঁদের বিশ্বাস এই সকল সম্ভাবনার বিপদজনিত প্রভাব হয়তো মারাত্মকভাবে পৃথিবীর বুকে দেখা যাবে না, অন্ততপক্ষে ২০৬৮ খ্রিস্টাব্দের আগে।

Latest article