আজও আমরা বিশ্বাস করি, ভারতবর্ষের ন্যায়ালয়গুলো নিরপেক্ষ। এবং এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে এখনও রাজনীতি প্রবেশ করতে পারেনি। যেখানে রাজনীতির কারবারিদেরও মাথা নত করে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু এসবই, ২০১৪-পূর্ববর্তী ধারণা। ২০১৩-এর সেপ্টেম্বরে রাজ্যসভায় জুডিশিয়াল আপোয়েন্টমেন্ট বিল ২০১৩ (সংবিধানের ১১২তম সংশোধনী) নিয়ে আলোচনা করার সময় তৎকালীন বিরোধী দল বিজেপির নেতা অরুণ জেটলির একটি বক্তব্য অবশ্যই স্মরণীয়। যে ভিডিওটি এখনও বিজেপির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেও আছে। (যদিও জানি না, সেটি কতদিন বিজেপি তাদের চ্যানেলে রাখবে। নাকি নারদা ভিডিওর মতো এটিকেও উড়িয়ে দেবে)। সেই ভিডিওতে অরুণ জেটলি স্পষ্টত, বিচারব্যবস্থাকে রাজনীতির প্রভাব থেকে সর্বোতভাবে বাইরে রাখার জন্য সরব হচ্ছেন।
আরও পড়ুন-আজ নেত্রীর জনসভা ডাবগ্রামে, অভিষেকের রোড শো কোচবিহারে
ইতিহাসের কী অদ্ভুত পরিহাস! অরুণ জেটলি আজ প্রয়াত। কিন্তু, সেই সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দল আজ ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতায়। এবং এই কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরুদ্ধেই আজ সবচেয়ে বেশি করে, জুডিশিয়ারি তথা গোটা বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে পরিচালনা করার অভিযোগ আসছে। যে অভিযোগকে মান্যতা দিয়েই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপি-যোগ। যার প্রতিটা রায় নিয়ে প্রথম থেকে প্রশ্ন তুলেছে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস থেকে আম জনতা। বিভিন্ন সময়ে যার বেশিরভাগ রায়কেই খারিজ করেছে কলকাতা হাইকোর্টেরই ডিভিশন বেঞ্চ বা ভারতের সর্ব্বোচ্চ ন্যায়ালয়। গত দু’বছর ধরেই বিচারপতির আসনে বসে নিজের ‘ইমেজ বিল্ড আপ’-এর কাজটি সুনিপুণভাবে করে চলেছেন এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি। সঙ্গে পেয়েছেন কিছু বিক্রিত ‘গোদি মিডিয়া’কে। এবং পরবর্তীতে নিজের অবসর-পরবর্তী জীবনকে সুরক্ষিত করতে সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে হাজির হয়েছেন। যেন সত্তর-আশির দশকের হিন্দি ছবির ক্লাইমাক্স। ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো।’ চন্দ্রবিন্দুর গানের ভাষায়, ‘লাস্ট সিনেতে স্লো মোশনে ঢিসুম মারেন গুরু!’
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের রিপোর্টে সেরা রাজ্যের ৪ হাসপাতাল
কিন্তু বিচারপতির আসনে বসে একেক সময় একেকটা বাজার গরম করা পর্যবেক্ষণ দেওয়া যতটা সহজ। বাস্তবের রাজনীতির ময়দানটা তার চেয়ে কয়েকশো গুণ রুক্ষ। পর্যবেক্ষণ। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গত দেড়-দু’বছরে রায় সেভাবে কিছু দেনইনি। তার অন্যতম কারণ, এই নিয়োগ সংক্রান্ত মামলাগুলোর ‘ট্রায়াল’ই শুরু হয়নি এখনও! বেশিরভাগ নিয়োগ-তদন্তই শেষ করতে পারেনি এখনও সিবিআই, ইডি। সেখানে উনি রায় দেবেনই বা কী করে! উনি যেটা করেছেন, তা হল পর্যবেক্ষণ। যা কিছু বললে খবরে থাকা যায়। মিডিয়ায় মুখ দেখানো যায়। ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে ‘নার্সিজম’। সহজ বাংলা করলে আত্মমগ্নতা। উনি আসলে নার্সিজমে আক্রান্ত একজন মানুষ। উনি জানতেন এজলাসে শুধু মামলার বিষয়ে শুকনো আলোচনা করলে কোনও টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য বির্তকের বিষয় তিনি কিছুতেই হবেন না। তাই এজলাসে বসে কখনও তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেন, কখনও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কখনও আবার, পশ্চিমবঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার সাথে দূর— দূর অবধি সম্পর্কবিহীন রাহুল গান্ধীর সম্পত্তির হিসেব জানতে চান! এসবই আসলে প্রচারে থাকার কৌশল। আর ভিতরে ভিতরে নিজেকে বিজেপির আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করার প্রক্রিয়ার অংশ। বিজেপির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট! বিজেপি সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাস করতে চায়। অবসর-পরবর্তী নিশ্চিত জীবনের প্রলোভন কম-বেশি বিজেপি দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ন্যায়ালয়ের বিচারপতিদেরই আজকাল সম্ভবত দেয়। কেউ কেউ সেই প্রলোভনে পা দেন। অবসরের পর রাজ্যসভার সাংসদ পদ। কিংবা কোনও রাজ্যের রাজ্যপালের মতো লোভনীয় ‘অফার’ বিজেপির ঝুলিতে থাকে। আর বেশি ‘না’ বললে, শিড়দাঁড়া রেখে প্রতিবাদ করলে, জাস্টিস লোয়ার মতো পরিণতি কেইবা চায়? (জাস্টিস লোয়া সম্পর্কে বিশদে জেনে থাকলে ভাল না হলে গুগল সার্চ করে একবার দেখে নেবেন)। তার চেয়ে রঞ্জন গগৈর মতো সুখের অবসরকালীন জীবন কাটানোটা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের। অভিজিৎবাবুও সেরকমই ভেবেছেন সম্ভবত।
তাই অবসরের ৫ মাস আগে তিনি সরাসরি বিজেপির হয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড়বড় কথা বলে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এসেছিলেন যে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সেই তিনিই সারদা মামলায় সিবিআই-এর এফআইআর-এ নাম থাকা শুভেন্দু অধিকারীর হাত থেকে পতাকা নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন-আজ নেত্রীর জনসভা ডাবগ্রামে, অভিষেকের রোড শো কোচবিহারে
সংবাদমাধ্যমে বসে বলছেন, নারদায় শুভেন্দু অধিকারী আদৌ কাগজে মুড়িয়ে টাকা নিয়েছিলেন? অন্য কিছুও তো হতে পারে? বটেই তো! যেমন আপনার ঘাড়ের নীচ থেকে কক্সিক হাড় অবধি যে হাড়টা সাধারণ মানুষের থাকে, সেইটা নেই। তার জায়গায় অন্য কিছুই আছে। কারণ, ওই হাড়টাকে মেরুদণ্ড বলে, যেটা আপনার নেই। ক্ষমতার লোভ সেই হাড়টাকে ক্ষয়ে দিয়েছে। বাজারি মিডিয়ার হাওয়ায় ‘ভগবান’ ভেবে নেওয়া আপনি বুঝতে পারছেন না কখন ক্ষমতার লোভে নিজের মধ্যে ‘লেডি ম্যাকবেথ’-এর প্রতিভূ তৈরি হয়ে গেছে আপনার মধ্যে। যে এসএসসি-চাকরি প্রার্থীদের উসকিয়ে, বোকা বানিয়ে এই অভিজিৎ গাঙ্গুলির ‘ভগবান’ সেজে ওঠা, তাদেরকেই তিনি ভুলে গেছেন। স্পষ্ট বলেছেন যে এইভাবে ধরনায় বসে চাকরি হয় না। সরকারকে বিপাকে ফেলতে এইভাবেই এই ছেলেমেয়েগুলোকে ব্যবহার করছেন এঁরা। সদ্য বিচারপতির আসনত্যাগী আজ বিবৃতি দিচ্ছে পাড়ার বাহুবলীর মতো। নিজেকে বিষাক্ত সাপ, কেউটে— এইসব বলতে শুরু করেছেন! আমাদের ভাবতে লজ্জা হয়, যে-বিচারপতির চেয়ারে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বহু প্রাজ্ঞ ভুবনবিখ্যাত বাঙালি বসেছিলেন সেখানে কতটা অবক্ষয় হলে এমন মনোভাব, এমন ভাষায় কথা বলা লোক সেই আসন অলংকৃত করেছিলেন। চাকরিপ্রার্থীদের যোগ্যতার বিচার করতে বসা অভিজিৎবাবুর ভাঙা, ভুল ইংরেজি শুনলে আজকের প্রজন্মের স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়েরাও হাসবে। খাপ পঞ্চায়েতি কায়দায় বিচার করতে বসে অঙ্কিতা, ববিতা, অনামিকা করে একই চাকরির তিনবার হাতবদল করেছিলেন আপন তুঘলকিপনায়।
আরও পড়ুন-মোদির বারাণসীতে পুলিশে নির্লজ্জ গেরুয়াকরণ বিজেপির, ইউনিফর্মের বদলে গেরুয়া বসন!
তবে সবশেষে আপনাকে একটাই কথা অরণ্যদেববাবু, রাজনীতির ময়দানে আপনাকে স্বাগত। বরং বলব বিচারপতির আসনের চেয়ে আপনাকে বিজেপির ঝান্ডাতেই বেশি ভাল মানিয়েছে। কারণ আপনি এখানেই যোগ্য। অতি দ্রুত শুভেন্দু, দিলীপ ঘোষের ভাষাও আয়ত্ত করে নিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার এজলাস নয়, যে আপনি হুকুম দেবেন আর সবাই সেই হুকুম পালন করতে বাধ্য হবে। আপনি যে বিষাক্ত সাপ তা আপনি নিজমুখে না বললেও চলত। কিন্তু আমাদের কাছেও কার্বোলিক অ্যাসিডের কমতি নেই গঙ্গোপাধ্যায়বাবু। এটা জনতার আদালত। এখানে শেষ রায় দেয় মানুষই। আসুন, গাঙ্গুলিবাবু খেলা হবে! (শেষ)