বিদায়ী লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা এবারের ভোটে বেশ বিপাকে পড়েছেন। রাজস্থানের কোটা-বুন্ডি লোকসভা কেন্দ্রের তিনি বিজেপি (BJP) প্রার্থী। ২০১৪ সাল থেকে বিড়লাজি জিতে আসছেন একই কেন্দ্রে। গতবার বড় মার্জিনে জিতেছিলেন। কিন্তু তাঁকে এবার কোটায় রীতিমতো কোণঠাসা করে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ প্রার্থী প্রহ্লাদ গুজ্জর। কংগ্রেসের টিকিটে লড়ছেন তিনি। কিছুদিন আগেও প্রহ্লাদ ছিলেন কোটা লোকসভা আসনের অন্তর্গত একটি বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক। গুজ্জর সমাজের মধ্যে প্রহ্লাদের প্রভাব অসীম।
সেই ফ্যাক্টর ছাড়াও দিল্লির গেরুয়া শিবিরকে ভাবিয়ে তুলেছেন ‘মহারানি’! কয়েকমাস আগে রাজস্থানের বিধানসভা ভোটে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে ব্রাত্য রেখেই লড়েছিল বিজেপি। গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজ পরিবারের প্রভাব মধ্যপ্রদেশের চেয়ে রাজস্থানেও কম নয়। ঢোলপুর রাজ পরিবারের মহারানি বসুন্ধরা দুটি টার্মের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বিজেপির এই গুরুত্বপূর্ণ নেত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হলেন প্রহ্লাদ গুজ্জর। আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘খাস-আদমি’ হিসাবে পরিচিত ওম বিড়লা। লোকসভার অধ্যক্ষের সঙ্গে আবার বসুন্ধরার সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলার।
পরিস্থিতি এমনই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে যে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল শর্মাকে দিল্লি থেকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোটা কেন্দ্রে যেন বাড়তি নজর দেওয়া হয়। নির্দেশ পেয়ে তড়িঘড়ি কোটা অঞ্চলের বিজেপি’র কর্মকর্তাদের ডেকে জয়পুরে জরুরি বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আসলে কংগ্রেসকে হটিয়ে রাজস্থানে ক্ষমতা দখল করলেও, লোকসভার ভোটে বিভিন্ন কেন্দ্রে বসুন্ধরার অনুগামী বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা-নেত্রীরা শাসক দলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
কেবল রাজস্থান নয়, ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই নানা সমস্যা গেরুয়া শিবিরকে (BJP) নানা রাজ্যে তাড়া করছে। রাজস্থানের লাগোয়া মধ্যপ্রদেশ নিয়েও বিস্তর মাথা ঘামাতে হচ্ছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে। ওই রাজ্যে ‘বাগী’ শিবরাজ সিং চৌহান হলেন দিল্লির মাথাব্যথার বড় কারণ। বিগত বিধানসভার নির্বাচনে দল ভাল ফল করলেও শিবরাজ, যিনি ‘মামা’ নামেই বেশি পরিচিত, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে দেয়নি পদ্মফুলের প্রধান পুরোহিতরা। সংঘ পরিবারের একনিষ্ঠ সৈনিকের অনুগামীর সংখ্যা মধ্যপ্রদেশে খুব একটা কম নয়। তিন তিনবারের মুখ্যমন্ত্রীর অনুগামীদের একটা অংশ তলে তলে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতে লিপ্ত বলে খোদ দলের মধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। এমনকী শিবরাজ নিজে যাতে বিদ্রোহী হয়ে মাঠে না নামেন, তার জন্য তাঁকে বিজেপির একটি নিরাপদ লোকসভা আসনে প্রার্থীও করা হয়েছে।
গোবলয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হল উত্তরপ্রদেশ। সেখানে ‘রাজপুত বিদ্রোহ’কে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বেকায়দায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং গুজরাটের রাজকোট কেন্দ্রের পদ্মফুলের প্রার্থী পুরুষোত্তম রূপালা ভোটপ্রচারে রাজপুতদের জাত তুলে নিজের দলকেই চরম অস্বস্তিতে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজপুত সমাজ আসলে মোঘলদের পা-চাটা ছিল। বরাবর তাদের তোষামোদ করে এসেছে ওরা। এমনকী রাজপুত-বাংলা রাজ পরিবারগুলি নিজেদের ঘরের মেয়েদের মোঘল বাদশাদের সঙ্গে বিয়েও দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এহেন মন্তব্য আগুনে ঘি পড়েছে, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রেদেশের পর রাজপুতদের প্রতিবাদ-আন্দোলন আছড়ে পড়েছে উত্তরপ্রদেশেও। রাস্তা-অবরোধ থেকে সবই চলছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে। একটাই দাবি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়ে রূপালাকে ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। এই দাবিকে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশের মীরাঠে ১৬ এপ্রিল মহা-সমাবেশের ডাকে দিয়েছে ক্ষত্রিয় সমাজ। এই আন্দোলনে বিজেপি বিক্ষুব্ধরাও আছে বলে শোনা যাচ্ছে। পশ্চিম ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মহারাষ্ট্রে আবার বিজেপির মহাসমস্যা মুখ্যমন্ত্রী একনাথ সিন্ডের শিবসেনাকে ঘিরে। উদ্ধব ঠাকরের দল ভেঙে এসে শিবনাথ হাত মেলান গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার দখল করেন বিজেপির সমর্থনে। লোকসভা ভোটযুদ্ধে আগেরবার জেতা শিন্ডের দিকে থাকা ৪ এমপির আসন দাবি করেছে পদ্মফুল শিবির, কারণ হিসাবে বিজেপি বলছে, তাদের কাছে খবর আছে, ওই চারটি আসনে শিন্ডের অনুগামীরা জিততে পারবেন না। বিজেপি লড়লে জিতবে।
আরও পড়ুন- আজ জোড়া সভা মুখ্যমন্ত্রীর
এই যুক্তি মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী না পারছেন গিলতে না পারছেন ফেলতে। বিজেপির (BJP) দাবি না মানলে, একনাথের গদি টলে যেতে পারে। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের দখল নেওয়ার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছেন শরদ পাওয়ারের ভাইপো। বিক্ষুব্ধ এনসিপি নেতা অজিত পাওয়ার। বিজেপি তাঁর দিকে ঢলে পড়লেই শিন্ডের সর্বনাশ হবে। সুতরাং মহারাষ্ট্রের তিন শরিকের বিবাদে জটিল অবস্থা তথাকথিত এনডিএ জোটের।
কর্নাটকে তো বিজেপির ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছেন একা কে এস ঈশ্বরাপ্পা। দলের উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, দলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চরমে উঠেছে। ঈশ্বরাপ্পা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন বলে ঘোষণা করেছেন। শিবসেনা কেন্দ্রে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। উপ-মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যে বেশ কিছু অনুগামী ও বিদ্রোহের পথে পা বাড়াবেন বলে বিজেপির অন্দরমহলের আশঙ্কা।
যে যে রাজ্যের অবস্থা নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম সব কটি রাজ্যেই ৫ বছর আগের লোকসভা ভোটে বিজেপি (BJP) দারুণ ফল করেছিল। তাতেই তারা ৩০৩ আসনে পৌঁছতে পেরেছিল। এবার তো তারা ‘৪০০ পার’ হবে বলে গলা ফাটাচ্ছে। কিন্তু কোথা থেকে আসবে এত আসন? বরং ২০০ পেরোতে বিজেপির কালঘাম ছুটে যাবে বলে বিরোধীরা মনে করছে। পশ্চিমবঙ্গের কথা দিয়ে লেখা শেষ করব। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে ৪২টির মধ্যে ১৮টি জিতে ছিল বিজেপি। এবং এখনও তারা সব আসনের প্রার্থীর নামই ঘোষণা করতে পারেনি। আর বিজেপির আদি-নবর দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে। দুটি ঘটনা বীরভূমের সিউড়ি আসনে সদ্য প্রাক্তন আইপিএস অফিসার দেবাশিস ধর দলের প্রার্থী হয়েছেন। বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এই প্রার্থীর নাম তিনি সুপারিশ করেননি। যাঁরা করেছেন প্রার্থীকে জেতানোর দায় তাঁদেরই। বারাকপুর কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণার আগে ওই অঞ্চলে দলের মহিলা মোর্চা নেত্রী ফাল্গুনী মিত্র বলেছেন, দল বদলুদের নেওয়া চলবে না। তারপর অর্জুন সিংয়ের অনুগামীরা ফাল্গুনীদেবীর অফিস আক্রমণ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তাহলে গোটে দেশে বিক্ষুব্ধদের বাগে আনতেই কি বিজেপি-নেতৃত্ব ভোট পার করে দেবেন?