প্রথম দফার ভোটগ্রহণ হয়ে গিয়েছে ১৯ এপ্রিল। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে ১১ দিন। হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ। এতদিনেও কত শতাংশ ভোট পড়ল, সেটা সঠিকভাবে জানিয়ে উঠতে পারেনি জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তা নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হওয়ার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কমিশনের তরফে জানানো হল, প্রথম দফায় ৬৬.১৪ শতাংশ ও দ্বিতীয় দফায় ৬৬.৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটগ্রহণের দিন সন্ধ্যা সাতটায় দেওয়া প্রাথমিক হিসেবে অবশ্য এই দুই হার ছিল যথাক্রমে ৬০ ও ৬০.৯৬ শতাংশ। দু’টি পরিসংখ্যানের ফারাক প্রায় ৬ শতাংশের। সাধারণত এমনটা দেখা যায় না। উভয় পরিসংখ্যানের ফারাক থাকে সামান্যই। এবার তা নয়।
লোকসভা ভোটের মুখে যে তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন, এই আশঙ্কা অনেক দিন ধরেই করছিলেন কেজরিওয়াল। ইডির তরফে একের পর এক নোটিশ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি গরহাজির থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, এই নোটিসের কোনও আইনি বৈধতা নেই। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বিজেপি এই চক্রান্ত করেছে। শেষপর্যন্ত তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হয়। ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার কয়েক দিন পর, গত ২১ মার্চ আবগারি নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করে ইডি। বর্তমানে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর ঠিকানা তিহার জেল। গ্রেফতারিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন আপ সুপ্রিমো। কেজরিওয়ালের দাবি, লোকসভা নির্বাচনে যাতে প্রচার করতে না পারেন, সেই কারণেই তড়িঘড়ি তাঁকে জেলে পোরা হয়েছে। এর জন্য স্পষ্টভাবে তিনি আঙুল তুলেছেন মোদি সরকার তথা গেরুয়া শিবিরের দিকে। মঙ্গলবার কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির সময় নিয়ে ইডির দিকেই প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিল বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তর বেঞ্চ। বিচারপতি খান্না সরাসরি বলেন, এই মামলায় এ-পর্যন্ত কোনও কিছু বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। আর যদি হয়েও থাকে, তাহলে দেখান কেজরিওয়াল এ-বিষয়ে কীভাবে জড়িত। বলুন, কেন লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁকে গ্রেফতার করা হল? প্রশ্নের মুখে পড়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
গত নির্বাচনে গুজরাতের সব ক’টি আসনই দখল করেন মোদিরা। তার মধ্যে সুরাতে বিজেপির পক্ষে প্রদত্ত ভোট (৭.৯৬ লক্ষ) এবং জয়ের মার্জিন (৫.৪৮ লক্ষ) ছিল চমকপ্রদ। সব মিলিয়ে গুজরাতের ভিতরে অন্তত সুরাত আসনটি বিজেপির জন্য শুধু ‘নিরাপদ’ নয়, ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’। তা সত্ত্বেও সুরাতের ১৬.৫৬ লক্ষ ভোটার এবার ভোটদানের সুযোগ পেলেন না। ভোটগ্রহণের অনেক আগেই আসনটি চলে গেল বিজেপির ঝুলিতে! স্কুটিনিতে বাতিল হয় কংগ্রেস প্রার্থীর মনোনয়ন। ‘হাত’-এর ‘ডামি’ প্রার্থীর সম্ভাবনাও খারিজ করে দেন রিটার্নিং অফিসার। বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে বাকি ছিলেন বিএসপি এবং নির্দল-সহ আটজন। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, ২২ এপ্রিল তাঁরাও মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন! অমনি একমাত্র প্রার্থী, বিজেপির মুকেশ দালালকেই ‘বিজয়ী’ ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন- সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলকে নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ শিক্ষামন্ত্রীর
তিনটি ঘটনা আপাতভাবে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও আসলে এদের মধ্যে যোগসূত্র একটাই। মুখে যতই হম্বিতম্বি করুক আর বলুক, ‘ইসবার চারশো পার’ আসলে ওরা নিজেরাও বুঝে গেছে এবারের ভোটে জনগণ বলছেন ‘ইসবার পার্লামেন্ট কি বাহার’। শোনা যাচ্ছে, দুই পর্যায়ে ভোটের পর মোদির পেটোয়া সংস্থারাও আর ভরসা দিতে পারছেন না। নির্বাচন কমিশনও মোদিকে জেতাতে অসহায়। ইডি, সিবিআইকে অস্ত্র করে মোদিজির প্রতিহিংসার চিহ্নগুলি মানুষ বুঝে নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না। প্রথম দু-দফায় হিন্দু ভোটের আগ্রহ কমে যাওয়া এবং মুসলিম ভোটের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে বিজেপি সিঁদুরে মেঘ হিসাবে দেখছে।
মানুষও বুঝতে পারছেন, মোদির ফেরা মানে সংবিধান বদলের আশঙ্কা। মোদির ফেরা মানে আরও বেশি শক্তি সংগ্রহ করে এক স্বৈরাচারীর প্রত্যাবর্তন, মোদির ফেরা মানে দেশ জুড়ে এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, মোদির ফেরা মানে দেশে আরও হিংসার বাতাবরণ, মোদির ফেরা মানে দেশের সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাওয়া, মোদির ফেরা মানে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার অবসান, মোদির ফেরা মানে পাকিস্তানের মতো ভারত নামক এক মৌলবাদী রাষ্ট্রের জন্ম, মোদির ফেরা মানে আরও কয়েকটি গোধরা। এমনকী অনেকেই ভাবছেন, মোদির ফেরা মানে এটাই হয়তো শেষ নির্বাচন। গণতন্ত্রের কবরে পোঁতা হতে পারে শেষ পেরেক। এসব সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছেন। বহু হিন্দুই আজ মোদির হিন্দুত্বকে মানেন না। মোদির রাজনৈতিক হিন্দুত্ব আসলে ক্ষমতা দখলের একটা টোপ। এসব দেখে আরএসএসও এখন প্রমাদ গুনছে। তারা বুঝতে পেরেছে, একদিন দেশে হিন্দুত্বের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে মোদিকে অবাধে উড়তে দিয়ে ভুল করেছিলেন।
সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ নন মোদি, তাঁর দায়বদ্ধতা স্বৈরতন্ত্রের কাছে। এখন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সঙ্ঘ পরিবারও বুঝতে পারছে, মোদিরাজ মানে সঙ্ঘের ক্ষতি। তাই সঙ্ঘ চাইছে, মোদি যেন কখনওই সওয়া দুশো পার করতে না পারেন। দু-দফায় মানুষের ভোটের ইঙ্গিত বলছে, ভাটার টানে আসন সংখ্যা দুশোর আগেই থমকে যাবে।
আগামী পাঁচ দফার ভোটে তাই বুঝে-শুনে বোতাম টিপবেন। অনিবার্য পতনকে অবশ্যম্ভাবী করার জন্য যা করতে হয়, সেটাই করবেন। ভারতের আগামী আপনার হাতে, আপনাদের হাতে। তাই, নো ভোট টু বিজেপি।